অনেক দূরে হাটের ফেরতা কোনো ব্যথিতা পল্লি-বধূ মেঠো সুরে মাঠের বিজন পথে গেয়ে যাচ্ছিল, –
‘পরের জন্যে কাঁদ রে আমার মন,
হায়, পর কি কখন হয় আপন?’
আমি মনে মনে বললাম – হয় রে অভাগি, আপন হয়; তবে অনেকে সেটা বুঝতে পারে না। বুকের ধনকে ছেড়ে গেলেই লোকে ভুল বুঝে বলে, –
‘পর কি কখন হয় আপন?’
আর একজনও ঠিক এমনই ভুল করে আমায় ছেড়ে গেছে, সে বেদনা ভুলবার নয়!
পথের বিরহিণীর ওই প্রাণের গান আমায় মনে করিয়ে দিলে অমনি আর একজন অভিমানিনীর কথা। সেই দিল-মাতানো স্মৃতিটি মাঝিহারা ডিঙির মতো আমার হিয়ার যমুনায় বারে বারে ভেসে উঠছে!
তাতে-আমাতে পরিচয় তো শুধু ছেলেবেলা থেকে নয় – তারও অনেক আগে থেকে; সেই চির-পরিচয়ের দিন তারও মনে নেই, আমারও মনে নেই। …
আমাদের পাড়াতেই তার বাড়ি।
তাকে আমার বিশেষ করে দরকার হত সেই সময়, যখন কাউকে, মারবার জন্যে আমার হাত দুটো ভয়ানক নিশ-পিশ করে উঠত। এ-মারারও আবার বিশেষত্ব ছিল; যখন মারবার কারণ থাকত, তখন তাকে মারতাম না, কিন্তু বিনা কারণে মারাটাই ছিল আমার খেপা-খেয়াল। আমার এ-পিটুনি খাওয়াটাকে সে পছন্দ করত কি না জানি নে, তবে দু-দিন না মারলে সে আমার কাছে এসে হেসে বলত, – ‘কই ভাই, এ দু-দিন যে আমায় মারনি?’
আমি কষ্ট পেয়ে বলতাম, – ‘না রে মোতি, তোকে আর মারব না!’ তার পর, সে সময় আমার হাতের সামনে যা-কিছু ভালো জিনিস থাকত, তাই তাকে দিয়ে যেন আমার প্রাণে গভীর তৃপ্তি আসত! মনে হত, এই নিয়ে সে হয়তো আমার আঘাতটাকে ভুলবে।
বই থেকে ছবি ছিঁড়ে তাকে দেওয়াই ছিল আমার সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। এর জন্যে প্রায়ই পাঠশালায় সারা দিন কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। কিন্তু যখন দেখতাম যে, আমার দেওয়া ওই মহা উপহার সে পরম আগ্রহে আঁচলের আড়াল করে নিয়ে গিয়ে তার পুতুলের বিছানা পেতে দিয়েচে, কিংবা তার খেলাঘরের দেওয়ালে ভাত দিয়ে সেগুলো এঁটে দিয়েছে, তখন আমার পাঠশালার সব অপমান ভুলে যেতাম। কিন্তু তার ওই মেনি বিড়ালটাকে আমি দু-চোখে দেখতে পারতাম না, তাকে যে অত আদর করবে রাতদিন, এ যেন আমার সইত না। সে আমায় রাগিয়ে তুলবার জন্যে কোনো দিন আমার দেওয়া সবচেয়ে ভালো ছবিটা আঠা দিয়ে ওই মেনি বিড়ালছানাটার পিঠে এঁটে দিত, আমিও তখন থাপ্পড়ের চোটে তার দুলালি বিড়ালবাচ্চাটাকে ত্রিভুবন দেখিয়ে দিতাম।
তার দেখাদেখি আমিও সময় বুঝে যেদিন সে রেগে থাকত বা মুখখানা হাঁড়ি-পানা করে বসে থাকত, তখন জোর ধুমসুনি দিয়ে তাকে কাঁদিয়ে ছাড়তাম। তখন আমার আনন্দ দেখে কে! সে যত কাঁদত, আমি তত মুখ ভেঙিয়ে তাকে কাঁদিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতাম। এক এক দিন তার পিঠের চামড়ার পাঁচটি আঙুলের কালো দাগ ফুটিয়ে তবে ছাড়তাম! আশ্চর্য হয়ে দেখতাম, ওই মার খাওয়ার পরেই সে বেশ শায়েস্তা হয়ে গেছে; আর, এক মিনিটে কেমন করে সব ভুলে গিয়ে জল ভরা চোখে মুখে প্রাণভরা হাসি এনে আমার আঙুলগুলো টেনে মুচড়িয়ে ফুটিয়ে দিতে দিতে বলছে, – ‘তোমার এই মারহাট্টা হাতের দুষ্টু আঙুলগুলোকে একেবারে ভেঙে নুলো করে দিতে হয়! তা হলে দেখি, তোমার ওই ঠুঁটো হাত দিয়ে কেমন করে আমায় মার!’ তার হাসি দেখে রেগে পিঠের উপর মস্ত একটা লাথি মেরে বলতাম, – ‘তাহলে এমনি করে তোর পিঠে ভাদুরে তাল ফেলাই!’
সে কাঁদতে কাঁদতে তার দাদাজিকে বলে দিত গিয়ে এবং তিনি যখন চেলা-কাঠ নিয়ে আমায় জোর তাড়া করতেন, তখন সে হেসে একেবারে লুটিয়ে পড়ত! রাগে তখন শরীর গশ-গশ করত। তাই আবার ফাঁকে পেলেই তাকে পিটিয়ে দোরস্ত করে দিতাম। কোনোদিন বা তার খেলা-ঘরের সব ভেঙে চুরে একাকার করে দিতাম, এই দিন সে সত্যি-সত্যি খেপে গিয়ে আমার পিঠে হয়তো মস্ত একটা লাঠির ঘা বসিয়ে দিন পনেরো ধরে লুকিয়ে থাকত, ভয়ে আর কিছুতেই আমার সামনে আসত না। সেই সময়টা আমার বড্ড দুঃখ হত। আ মলো, ও-লাঠির বাড়িতে আমার এ মোষ-চামড়ার কি কিছু হয়? আর লাগলই বা! তাই বলে কি বাঁদরি এমন করে লুকিয়ে থাকবে? তার পর যখন নানান রকমের দিব্যি করে কসম খেয়ে ফুসলিয়ে তাকে ডেকে আনতাম, তখন সে আমার লম্বা চুলগুলো নিয়ে নানান রকমের বাঁকা-সোজা সিঁথি কেটে দিতে দিতে বলত ‘দেখো ভাই, আর আমি কখ্খনো তোমায় মারব না! যদি মারি তো আমার হাতে যেন কুঠ হয়, পোকা হয়!’
তারপরে হঠাৎ বলে উঠত, –‘আচ্ছা ভাই, তুমি যদি আমার মতোন বেটি ছেলে হতে, তাহলে বেশ হত, – নয়? – দাও না ভাই, তোমার চুলগুলো আমার ফিতে দিয়ে বেঁধে দিই।’ কোনোদিন সে সত্যি-সত্যিই কখনো কথা কইতে কইতে দুষ্টুমি করে চুলে এমন বিউনি গেঁথে দিত যে, তা ছাড়াতে আমার একটি ঘন্টা সময় লাগত।…
তার পর কী হল? …
এই শূন্য মাঠের খানিকটা রাস্তা পেরিয়েই আমার মনের শাশ্বত শ্রোতা জিজ্ঞেস করে উঠল, – হাঁ ভাই, তার পর কী হল?
আমার হিয়ার কথক কিছুক্ষণ এই নিঝুম সাঁঝের জমাট নিস্তব্ধতার মাঝে যেন তার কথা হারিয়ে ফেললে! হঠাৎ এই নীরবতাকে ব্যথিয়ে সে কয়ে উঠল, – ‘না – তোমায় আমি ভালোবাসি! সেদিন মিথ্যা কয়েছিলাম মোতি, মিথ্যা কয়েছিলাম!’ তার এই খাপছাড়া আক্ষেপ সাঁঝের বেলায় তোড়ি রাগিণী আলাপের মতো যেন বিষম বে-সুরো বাজল! – সে আবার স্থির হয়ে তার সুর-বাহারে পুরবির মূর্ছনা ফোটালে! চির-পিয়াসি আমার চিরন্তন তৃষিত আত্মা প্রাণ ভরে সে সুর-সুধা পান করতে লাগল!