এক নিমেষে আমার লুপ্ত জ্ঞান যেন ফিরে এল। আমি সোজা হয়ে বসে বসলুম, – ‘আপনি সব জানেন?’
তিনি করুণ হাসি হেসে বললেন, – ‘তুমি বোধ হয় জান না, যে, আজহার আমার অনেক দিনের বন্ধু। আমরা বরাবর দুজনে এক সঙ্গেই পড়েছি। সে যাবার আগে আমায় সব বলেছে! তাকে আমি বরাবরই চিনি, – সে মিথ্যা বলে না, সে শিশুর মতোই সরল। তবু সকল কথা জেনেও মনে হচ্ছে, আমি তাকে সুখী করতে গিয়েও কী যেন মস্ত অন্যায় করেছি। এখন ভাবছি যে, তাকে সুখী তো করতেই পারিনি, উল্টে তার দুঃখ-কষ্টকে হয়তো আরও বাড়িয়ে দিয়েছি। সে হতভাগা বোধ হয় শান্তিতে মরতেও পারবে না! এই আমার জীবনে প্রথম আর শেষ অন্যায়। – সে আমার পা ধরে মুক্তি চেয়েছিল। তখন কিন্তু বুঝিনি, সে কোন্ মুক্তি! – আমার সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছি পরি, কিন্তু এতে আত্মতৃপ্তির চেয়ে আত্মগ্লানিই বেশি করে পেলুম; কেননা আমার অবস্থাটা এখন সেই রকমের হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা সবাইকে সন্তুষ্ট করতে চায়, অথচ কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারে না! … আজহার প্রতিজ্ঞা করেছে যে, এই কথাটা তার জীবনে আর দ্বিতীয়বার মুখ দিয়ে বেরুবে না, আর তার সত্যে আমার বিশ্বাস আছে। সে তোমাকে সুখী করবার জন্যে আমায় অনুরোধ করেছে। – বলো পরি, তুমি কিসে সুখী হবে?’
আমি তাঁর পায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বললুম, – ‘তুমি আমায় এক বিন্দু ছেড়ে থেকো না, তোমার এই পায়ে এমনই করে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে দিয়ো। আমার বড়ো কষ্ট!’…
অনেকক্ষণ পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসে থেকে তিনি আমায় বুকে তুলে নিয়ে বললেন, – ‘না পরি, পায়ে কেন, এই বুকে করে রাখব! এমন রত্ন সে হতভাগা কী করে জান ধরে আমায় বিলিয়ে দিতে পারল, তাই ভাবছি!’ – বলেই হেসে উঠলেন।
এক মুহূর্তে এই সোজা লোকটির সরলতায় আমার বুক বেদনায় আর শ্রদ্ধায় আলোড়িত হয়ে উঠল। তবু মনে মনে না বলে পারলুম না যে, এমন করে বিলিয়ে দিতে গেলে যে বড্ড বেশি ভালোবাসতে হয় আগে, এ ক্ষমতা কি যার তার থাকে? আবার কী মনে করে তিনি আমায় বলে উঠলেন, – ‘যা হয়ে গেছে, তার জন্যে খামোখা লজ্জিত হয়ো না পরি। – বীর সে, দেশের কাজে গিয়েছে, তাকে আর ডেকো না। মনে করো, যা হয়ে গেছে, তা শুধু ঘুমের ঘোরে!’ বলেই তিনি আবার মাথাটা জোর করে তুলে সুর করে গাইতে লাগলেন, –
‘সধবা অথবা বিধবা তোমার রহিবে উচ্চ শির,
উঠো বীর জায়া, বাঁধো কুন্তল, মুছো এ অশ্রু-নীর!’
এ কী রহস্য খোদা! … এ দেবতাকে যেন কোনোদিন প্রতারণা করি না, এই শক্তি দাও, হৃদয়ে এমনই বল দাও! – এখন শুধু শিশুর মতো ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আমার। শান্তি দাও খোদা, শান্তি দাও এঁকে – তাঁকে, আর এমনই ব্যথিত বিশ্ববাসীকে!
আহা! ভালোবাসা দিয়ে যারা ভালোবাসা পায় না, তাদের জীবন বড়ো দুঃখের, বড়ো যাতনার! আবার এই জন্যে সেটা এত যাতনার যে, ওই না-ভালোবাসার দরুণ কাউকে অভিযোগ করবারও নেই। জোর করে তো আর কাউকে ভালোবাসানো যায় না।
আমি কি আবার ভালোবাসতে পারব গো! কী করে ভুলব? যে বিদায় নিয়ে এমন করে জয়ী হয়ে চলে গেল, তাকে যে সারা জীবনেও কিছুতেই ভোলা যায় না! তিনি যদি আমার সামনে থেকে অন্য কোনো দিকে জীবনটা সার্থক করে তুলতেন, তা হলে হয়তো তাঁকে ভুলতেও পারতাম। সব হারিয়ে যে এমন জীবনটা ব্যর্থ করে দিলে এই হতভাগিনির জন্যে, হায়! তাকে কি ভোলা যায়? নারীর ভালোবাসা কি এত ছোটো?
ওই যে এখনও আমার স্বামী তেমনই হাসিমুখে গাচ্ছেন, –
‘ওগো দেখি আঁখি তুলে চাও,
তোমার চোখে কেন ঘুম-ঘোর!’
১০. অতৃপ্ত কামনা
সাঁঝের আঁধারে পথ চলতে চলতে আমার মনে হল, এই দিনশেষে যে হতভাগার ঘরে একটি প্রিয় তরুণ মুখ তার ‘কালো চোখের করুণ কামনা’ নিয়ে সন্ধ্যাদীপটি জ্বেলে পথের পানে চেয়ে থাকে না, তার মতো অভিশপ্ত বিড়ম্বিত জীবন আর নেই!
আমারই বেদনা-রাগে রঞ্জিত হয়ে গগনের পশ্চিম দুয়ারে জ্বালা সন্ধ্যা-তারা আমার মুখে তার অশ্রু-ভরা ছল-ছল চোখ নিয়ে চেয়ে ওই কথাটিতে সায় দিলে। ঝিল্লি-তান-মুখরিত মাঠের মৌন পথ বেয়ে যেতে যেতে শ্রান্ত চিন্তা কয়ে গেল, – ‘তোমায় ব্যথা বোঝে শুধু ওই এক সাঁঝের তারা!’
যদি কোনো ব্যথাতুর একটি পল্লি হতে আর একটি পল্লিতে যেতে এমনই সাঁঝে একা শূন্য মাঠের সরু রাস্তা ধরে চলতে থাকে – তার সামনে এক টুকরো টাটকা কাটা-কলজের মতো এই সন্ধ্যাতারাটি ফুটে ওঠে, তবে সেই বুঝবে কত বুক-ফাটা ব্যথা সে সময় তার মনে হয়ে তাকে নিপীড়িত করতে থাকে।
এই মলিন মাঠের শূন্য বুকে কিছু শোনা যাচ্ছে না, শুধু কোথায় সান্ধ্য নীড়ে বসে একটি ‘ধূলো-ফুরফুরি’ শিস দিয়ে দিয়ে বাউল গান গাইছে, আর তারই সূক্ষ্ম রেশ রেশমি সুতোর মতো উড়ে এসে আমার আনমনা-মনে ছোঁয়া দিচ্ছে! একটি দুটি করে আশমানের আঙিনায় তারা এসে জুটছে, আমার মনের মাঝেও তাই অনেক দিনের অনেক সুপ্ত কথার, অনেক লুপ্ত স্মৃতির একটির পর একটির উদয় হচ্ছে।….
আমার এই একই কথা, একই ব্যথা যে কত দিক দিয়ে কত রকমে মনে পড়ছে, তার আর সংখ্যা নেই। তবু বারে বারে ও-কথাটি ও-ব্যথাটি জাগবেই! মন আমার এ বেদনার নিবিড় মাধুর্যকে আর এড়িয়ে যেতে পারলে না। সাপ যেমন মানিক ছেড়ে তার সেই মানিকটুকুর আলোর বাইরে যেতে পারে না, আমারও হয়েছে তাই। আমার এই বুকের মানিক বেদনাটুকুর অহেতুক অভিমানের মায়া এড়িয়ে যেতে পারলাম না!