সে আমার গান শুনেছিল কিনা জানি নে। কিন্তু সে সময় মেঘের ঝরা থেমেছিল, আর তার বাতায়ন চিরে ম্লান একটু দীপশিখা আমার বিজন কুটিরে কাঁপতে কাঁপতে নেমেছিল! … তার পরে ঝড়ো হাওয়ার সাথে মেতে আগল-ছাড়া পাগল মেঘের ওই একরোখা শব্দ, – রিম্ – ঝিম্ – রিম। …
* * *
বিসর্জনের দিন। নহবৎ-খানায় তারই বিসর্জনের বাজনা বাজছে। সান্ত্বনা আর অশান্ত একবুক বেদনা – এই দুটো মিলে আমায় এমন অভিভূত করে ফেলেছে যে, অতি কষ্টে আমার এ শ্রান্ত দেহটাকে খাড়া করে রেখেছি। আর – আর একটু পরেই যেন খুঁটি-দিয়ে খাড়া করা এই জীর্ণ ঘরটা হুড়মুড় করে ধসে পড়বে। …
বাইরে বেরিয়ে এলুম। সেখানেও ওই একই একটা অস্বস্তি আর অরুন্তুদ যন্ত্রণা! নিদাঘ সাঁঝের ধূসর আকাশ ব্যথায় উদাস-পাণ্ডুর হয়ে ধরার বুক আঁকড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল, আর অলক্ষ্যে ক্রমেই সে বেদনায় গুমোট কালো জমাট হয়ে আসছিল। আমের মুকুলের সাথে পাশের গোরস্থান থেকে গুলঞ্চের মালঞ্চ যে করুণ সুগন্ধের আমেজ দিচ্ছিল, তাতে আমি কিছুতেই কান্না চেপে রাখতে পারছিলুম না। ওঃ! সে কী দুর্জয় অহেতুক কান্নার বেগ! এই রোদনের সাথে একটা ক্লান্তি-ভরা স্নিগ্ধতাও যেন ফেনিয়ে আমার ওষ্ঠ পর্যন্ত ছেপে উঠেছিল!
* * *
পরির বিয়ে হল। দৃষ্টি-বিনিময় হল। সম্প্রদান হল। তার পরেই আমি আর এই কথাটা গোপন রাখতে পারলুম না, যে, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। তখন সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করলে যে, আমাদের মতো আত্মীয়-স্বজনহীন ভবঘুরে হতভাগাদের জন্যেই বিশেষ করে এই সৈন্যদলের সৃষ্টি! আমিও মনে মনে বললুম, – ‘তথাস্তু’। – দু-একজন বন্ধু মামুলি ধরনের লৌকিকতা দেখিয়ে একটু-আধটু দুঃখ প্রকাশও করলেন। সেদিন কেঁদেছিল শুধু আমার দূর সম্পর্কের একটি ছোটো বোন। তাই তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সে বললে, – ‘যাও ভাই-জান! হয়তো আর তোমায় ফিরে পাব না! তবু কিন্তু তুমি বড়ো একটা কাজে যাচ্ছে যে, সেটায় বাধা দেওয়াও মস্ত পাপ আর স্বার্থপরতা। এমন একটা কাজে জীবন উৎসর্গ করতে গেলে দেশের কোনো বোনই যে তার ভাইকে বাধা দিতে পারে না! আমাদের দেশে বীরাঙ্গনা থাকলেও বীর-ভাইদের বোন হওয়ার মতো সৌভাগ্যবতী অনেক রমণী আছেন। তাঁরা নিশ্চয়ই নিজের ভাইকে বীর-সাজে সাজিয়ে দেশরক্ষা করতে পাঠাতে পারেন। ভুলে যেয়োনা ভাই-জান যে, রণদুর্মদ মুসলমান জাতির উষ্ণ রক্ত আমাদেরও দেহে রয়েছে! আমরাও আসছি সেই এই একই উৎস হতে। এ রক্ত তো শীতল হবার নয়!’ …
আমি আমার এই মুখরা বোনটিকে বড়ো বেশি স্নেহ করতুম। তাই তার সেদিনকার এই সব কথায় গৌরবে আমার বুক ভরে উঠেছিল! আমার অসংবরণীয় অশ্রু রুখতে গিয়ে দেখলুম ততক্ষণে আমার ছোটো বোনের চোখ দুটি জলে ভাসছে! তাকে আর কখনও কাঁদতে দেখিনি। একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে অশ্রু-বিকৃত কণ্ঠে সে আমায় বললে, – ‘তোমাকে কেউ বাধা দিতে নেই বলে তুমি হয়তো অন্তরে বড়ো কষ্ট পাচ্ছ ভাইজান, কিন্তু এটা নিশ্চয় জেনো যে, আমার মতো আজ অনেকেই তোমার কথা ভেবে লুকিয়ে কাঁদছে! – হাঁ, একটা কথা । একবার আমার সই পরিদের বাড়ি যাও। এ শেষ দেখায় কোনো লজ্জা-শরম কোরো না ভাই! পরি বড়ো অস্থির হয়ে পড়েছে, তার অন্তিম অনুরোধ, একবার তাকে দেখা দাও।’ …
হায় রে সংসার-মরুর স্নেহ-নির্ঝরিণী-স্বরূপা ভগিনিগণ! তোরা চিরকালই এমনই সন্ন্যাসিনী, অথচ ভারে ভারে পবিত্র স্নেহ ঘরে ঘরে বিলিয়ে বেড়াচ্ছিস! বড়ো দুঃখ তোদের সহজে কেউ চেনে না। যে হতভাগার বোন নেই, সেই বোঝে তার দুঃখ কষ্ট কত বড়ো! মুখে অনেক সময় তোদের কষ্ট দেবার ভান করলেও তোরা বোধ হয় সহজেই বুঝিস, যে, আমাদেরও বুকে তোদেরই মতো অনাবিল একটি স্নেহ-প্রীতির প্রশান্ত ধারা বয়ে যাচ্ছে, তাই তোরা মুখ টিপে হাসিস। আবার কাজের সময় কেমন করে এত বড়ো তোদের স্নেহ-বেষ্টনীকে ধূলিসাৎ করে দিস!
আমার এই বড়ো গৌরবের, বড়ো স্নেহের বোনটিকে আশীর্বাদ করবার ভাষা পাইনি সেদিন! তার আনত মস্তকে শুধু দু-ফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আমার প্রাণের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা জানিয়েছিল।
খুব সহজেই পরির সঙ্গে দেখা করতে গেলুম। এই নির্বিকার তৃপ্তিতে আমার নিজেরই বিস্ময় এল! কী করে এমন হয়? …
পরি নববধূর বেশে এসে যখন আমার পা ছুঁয়ে সালাম করলে, তখন বরষার স্রোতস্বিনীর চেয়েও দুর্বার অশ্রুর বন্যা তার চোখ দিয়ে গলে পড়ছে! মুহূর্তের জন্যে দুর্জয় একটা ক্রন্দনের উচ্ছ্বাসে আমার বুকটা যেন খান খান হয়ে ভেঙে পড়বার উপক্রম হল। প্রাণপণে আমি আমার অশ্রুরুদ্ধ কম্পিত স্বরকে সহজ সরল করে তার মাথায় হাত রেখে স্নিগ্ধ-সজল কণ্ঠে বললুম, ‘চির-আয়ুষ্মতী হও! সুখী হও!’
সে শুধু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল! তার পর মহিমময়ী রানীর মতোই চলে গেল!
যখন আমার ভাঙা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে একবার চারিদিকে শেষ-চাওয়া চেয়ে নিলুম, তখন মনে হল যেন সজনে ফুলের হাত-ছানিতে আমার পল্লি-মাতা আমায় ইশারায় বিদায় দিলে! একবার নদীপারে শিমুল গাছটার দিকে চেয়ে মনে হল যেন তার ডালে ডালে নিরাশ প্রেমিকের ‘খুন-আলুদা ’ হৃৎপিণ্ডগুলি টাঙানো রয়েছে! … সে দিন ছল-ছল ময়ূরাক্ষীর নির্মল ধারা তেমনই মায়ের বুকের শুভ্র ক্ষীর-ধারার মতোই বয়ে যাচ্ছিল!
স্বপ্নের মতো বিহ্বলতায় ভরা সে কোন্ সুরপুর হতে আধঘুমে গানের প্রাণস্পর্শী ব্যঞ্জনা আমার কানে এল, –