আমি জানি প্রিয়, সেদিন তোমার আসবেই আসবে, যেদিন আমার এই অভিশপ্ত জীবনের সকল কথা সকল আশা অন্তত তোমার কাছে লুকানো থাকবে না। এ তুমি নিজেই আপনা-আপনি বুঝতে পারবে, কাউকে তা বলে দিতে বা বুঝিয়ে দিতে হবে না। কিন্তু সেদিন কি আমি আর এ-জীবনে জানতে পারব প্রিয়, তুমি আমায় ভুল বোঝনি? তা যদি না জানতে পারি, তবে আপশোশ প্রিয়, আপশোশ! …
এই নাও, আমার সব গুলিয়ে গেল দেখছি! এ যেন ঠিক ঘুমের ঘোরে হাজার রকমের স্বপ্ন দেখার মতো! কোনোটার সঙ্গে কোনোটারই সামঞ্জস্য নেই, অথচ অলক্ষ্য থেকে স্বপ্ন-রানি সবগুলিকে একটি ক্ষীণ সুতো দিয়েই গেঁথে দিচ্ছে! আমার সব কথাগুলো যেন ঠিক লাখো ফুলের এলোমেলো মালা!
আবার আমার মনে হচ্ছে আমার পক্ষে তার কাছে ও-রকম করে কথা কওয়া বা দেখা দেওয়া কিছুতেই উচিত হয়নি। কেননা সে নিশ্চয় মনে করেছিল যে, আমি আমার মিথ্যা অহংকারকে কেন্দ্র করে তার কাছে ত্যাগের গর্ব দেখাতে গিয়েছিলুম, আর তাই হয়তো যখন এই কথাটা তার হঠাৎ মনে হল অমনি কেমন একটা বিতৃষ্ণায় তার মন ভরে উঠল, আর সে আমায় ও-রকম নির্দয়তা না দেখিয়েই পারলে না। – আর একটা কথা, কেউ একটু সামান্য প্রশ্রয় দিলেই আমাদের মতো স্নেহ-বুভুক্ষু হতভাগারা এতটা বাড়াবাড়ি করে তোলে যে, সে তখন এই দুর্ভাগাদের চেতন করিয়ে দিতে বাধ্য হয়, আর আমরা সেইটাকে হয়তো অপমানের আঘাত বলেই মনে করি। এটা তো আমাদেরই দোষ। –
অন্তরের গোপন কথা অন্তরেই না রাখতে পেরে বাইরে প্রকাশ করে দেওয়ার যে দুর্বার লজ্জা আর অক্ষমণীয় অপমান, তা হতে আমায় রক্ষা করো খোদা, রক্ষা করো! এর যা শাস্তি, তা বড়ো নির্মম নিষ্করুণ হয়েই আমার মাথার উপর চাপাও।
কিন্তু ঘুমের ঘোর আমার এখনও কাটেনি। মন এমন একটা জিনিস বা মনের এমন একটা দুর্বলতা আছে যে, সে সহজে কোনো জিনিসের শক্ত দিকটা দেখতে চায় না। বুঝলেও অবুঝের মতো সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চলতে চায়! কিন্তু আশ্চর্য এই যে, কে যেন মুণ্ডটা ধরে ওই নিষ্করুণ নীরস দিকটাই দেখতে বাধ্য করায়; সে বোধ হয়, মনেরই পেছনে প্রচ্ছন্ন একটা দুর্নিবার শক্তি।
দেখেছ মজা! আমার মন এটা নিশ্চয়ই জেনে বসেছে যে, সে আমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তবে সেদিন যে সে আমায় অপমান করে তাড়িয়ে দিলে? সে বড়ো দুঃখে গো, বড়ো দুঃখে! তার মতো অভিমানিনীর আত্মমর্যাদাকে ডিঙিয়ে চলার সামর্থ্য নেই। তাই বড়ো কষ্টে তাকে এত শক্ত হতে হয়েছিল, নইলে ওই নিষ্ঠুর কথাটা বলবার পরই কেন হুহু করে অশ্রুর হড়পা-বান বয়ে গেল তার চোখের বুকের সব আবরণ ভাসিয়ে দিয়ে! সব মিথ্যা হতে পারে, কিন্তু ওইটা – এত বড়ো একটা সত্য তো মিথ্যা হতে পারে না। অন্ধ, তুমি সেই সময় যদি তার মর্মন্তুদ ব্যথার বেদনা বুঝতে পারতে, তার এই অভিমান-বিধুর অকরুণ কথার উৎস কোথায় দেখতে পেতে, তাহলে আজ ওই মিথ্যা দুঃখটা তোমায় এত কষ্ট দিত না! সে যদি এত বেশি অভিমানিনী না হত, তা হলে সাধারণ রমণীর মতো অনায়াসে তোমার পায়ে মুখ গুঁজে পড়ে কেঁদে উঠত, – ওগো, অকরুণ দেবতা! খুব করেছ! খুব উদারতা দেখিয়েছ, আর এ হতভাগিনিকে জ্বালিও না! এতই দেবত্ব দেখাতে চাও যদি, তবে এসো না। কিন্তু তা হলে তো ‘আমার প্রিয় মহান!’ এই কথাটির গৌরবে আমার রিক্ত বুক এমন করে ভরে উঠতে পারত না! – ভালোই করেছ খোদা, তুমি ভালোই করেছ! প্রতিদিনের মতো আজ তাই বড়ো প্রাণ হতেই বলেছি, – তুমি চির মঙ্গলময়! আবার বলছি, – ‘তোমারই ইচ্ছা হউক পূর্ণ করুণাময় স্বামী!’
* * *
এ আর এক দিনের কথা! … পরি তার তে-তলার দালানের কামরায় বসে নিশীথ-রাতের সুষুপ্তিকে ব্যথিয়ে আনমনে গাচ্ছিল, – দিগ্বালারা আজ জাগল না। নব-ফাল্গুনে মেঘ করেছে। মুখর ময়ূরের কলকণ্ঠের সাথে মাঝে মাঝে আকুল মেঘের ঝমঝমানি শোনা যাচ্ছে, ঝিম ঝিম ঝিম! … নিত্যকার নৃত্যমুখর প্রভাত এখন রোজই স্তব্ধ হয়ে শুধু ভাবে আর ভাবে। বর্ষণ-পুলকিত পুষ্প-আকুলিত এই বল্লি-বিতানের আর্দ্র-স্নিগ্ধ ছায়ে বসে আমার মনে হয়, আমার প্রিয়তমাকে আমি হারিয়েছি, আবার মনে হয়, না, বড়ো বুক ভরেই পেয়েছি গো, তাকে পেয়েছি! – আজ আমার ফুল-শয্যার নিশিভোর হবে। এ ভোরে বারিও ঝরবে, বারি-বিধৌত ফুলও ঝরবে, আবার শিশুর-মুখের অনাবিল-হাসির-মতো শান্ত কিরণও ঝরবে। – ওগো আমার বসন্ত-বর্ষার বাসরনিশি তুমি আর যেয়ো না – হায় যেয়ো না!
আমার বিজন কুটিরে সেই গান আমার বিনিদ্র কানে যেন এক রোদন-ভরা প্রতিধ্বনি তুলছিল। – আমি ভাবছিলুম যে, হায় মাঝে আর তিনটি দিন বাকি! তার পর এই পনেরো বছরের চেনা-গলার মিঠা আওয়াজ আর শুনতে পাব না, এই আমার বিশ বছরের জীবনে জড়িয়ে-পড়া নিতান্ত আপনার মানুষটিকে হারাতে হবে। কিন্তু হয়তো সারা জনম ধরে এরই রেশ আমার প্রাণে বীণার ঝংকার তুলবে। … এই তিনটি দিনই মাত্র তাকে আমার বলে ভাবতে পারব, তার পরে আমার কাছে তার চিন্তাটা যেমন দূষণীয়, তার কাছেও আমার চিন্তাটা সেই রকম অমার্জনীয় অপরাধ হবে! আর এক জনের হয়ে সে কোনো দূর দেশে চলে যাবে, আমি চলে যাব সে কোন্ বাঁধনহারার দেশ পেরিয়ে। তার পর দীর্ঘ বিধুর-মধুর অলঙ্ঘনীয় একটা ব্যবধান! …
এই সব কথা মনে পড়তেই আমি বৃষ্টি-ধারার ঝম-ঝমানির সাথে গলায় সুর বেঁধে গাইলুম, – ওগো প্রিয়তম, এসো আমরা দু-জনেই পিয়াসি চাতক-চাতকীর মতো কালো মেঘের কাছে শান্ত বৃষ্টি-ধারা চাই। আমরা চাঁদের সুধা নেব না প্রিয়! আমরা তো চকোর-চকোরী নই। চাতক-মিথুন বাদলের দিনে আমরা চাইব শুধু বর্ষণের পূত আকুল ধারা। এসো প্রেয়সী আমার, এই আমাদের ফাল্গুনের মেঘ-বাদলের দিনে আমরা উভয়ে উভয়কে স্মরণ করি আর চলে যাই! এই বসন্ত-বর্ষার নিশীথিনীর মতোই আমার মনের মাঝে এসো তোমার গুঞ্জরণ-ভরা ব্যথিত চরণ ফেলে! … তার পরে দূরে দাঁড়িয়ে সজল চারিটি চোখের চাউনির নীরব ভাষায় বলি, – ‘বিদায়’! …