তার আয়ত আঁখির এক অনিমিখ চাউনি দিয়ে আমার পানে চেয়েই সে থমকে দাঁড়াল! শুক্ল জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখতে পেলুম, তার দুটি বড়ো বড়ো চোখে চোখ-ভরা জল! … এক পলকে পরির নূপূরের রুনু-ঝুনু শিঞ্জিনী চমকে যেন কী বলে উঠল। আনন্দ-ছন্দের হিন্দোলার দোল আর দুলল না! অসম্বৃতা তার লুণ্ঠিত চঞ্চল অঞ্চল সম্বৃত হল। শিথিলবসনার ফুল্ল কপোলে লাজ-শোণিমা বিদীর্ণপ্রায় দাড়িম্বের মতো হিঙ্গুল হয়ে ফুটল। সমীরের থামার সাথে সাথে যেন উলসিত-সরসী-সলিলের কল-কল্লোল নিথর হয়ে থামল, আর তারই বুকে এক রাস পাতার কোলে দুটি রক্ত-পদ্ম ফুটে উঠল। ত্রস্তা কুরঙ্গীর মতো ভীতি তার নলিন-নয়নে করুণার সঞ্চার করলে। বারবার সংযত হয়ে ক্ষীণকণ্ঠে সে কইলে, – ‘তুমি – আপনি কখন এলেন? –’
আমি বললুম, – ‘আজ এসেছি। তুমি বেশ ভালো আছ পরি?’
সে একটু ক্লিষ্ট হাসি হেসে কইলে, ‘হ্যাঁ, আজ এখানে মা আর আমাদের বাড়ির সকলে বেড়াতে এসেছেন। এ বাগানটা ভাইজান নতুন করে করলেন কিনা! – ওই যে তাঁরা পুকুরটার পাড়ে বসে গল্প করছেন।’
আমার নেশা যেন অনেকটা কেটে গেল। তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে বললুম, ‘ওঃ, আজ প্রায় দু-বছর পরে আমাদের দেখা, নয় পরি? তোমাকে যেন একটু রোগা-রোগা দেখাচ্ছে, কোনো অসুখ করেনি তো?’
সে তার ব্যথিত দুটি আঁখির আর্ত দৃষ্টি দিয়ে আমার পানে অনেকক্ষণ চেয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বললে, ‘– না! –’
তারপরেই যেন তার কী কথা মনে পড়ে গেল। সে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কয়ে উঠল, ‘আপনি! এখানে কেন আর? যান!…’ এক নিমেষে এমন আকাশভরা জ্যোৎস্না যেন দপ করে নিভে গেল! একটা অপ্রত্যাশিত আঘাতের বেদনায় সমস্ত দেহ আমার অনেকক্ষণের জন্যে নিসাড় হয়ে রইল। কখন যে মাথা ঘুরে পড়ে পাশের বেঞ্চিটার হাতায় লেগে আমার চোখের কাছে অনেকটা ফেটে গিয়ে তা দিয়ে ঝর-ঝর করে খুন ঝরছিল, আর পরি তার আঁচলের খানিকটা ছিঁড়ে আমার ক্ষতটায় পটি বেঁধে দিয়েছিল, তা আমি কিছুই জানতে পারিনি! যখন চোখ মেলে চাইলুম, তখন পরি আমার আঘাতটাতে জল চুঁইয়ে দিচ্ছে, আর সেই চোঁয়ানো জলের চেয়েও বেগে তার দুই চোখ বেয়ে অশ্রু চুঁয়ে পড়ছে! … এতক্ষণে আহত অভিমান আমার সারা বক্ষ আলোড়িত করে গুমরে উঠল! বিদ্যুদ্বেগে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আহত স্বরে বললুম, ‘বড়ো ভুল হয়েছে পরি, তুমি আমায় ক্ষমা করো!’
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে যেন কী সামলে নিয়ে, তার পরে আনমনে চিবুকছোঁয়া তার একটা পীত গোলাবের পাপড়ি নখ দিয়ে টুঙতে টুঙতে অভিভূতের মতো কী বলে উঠল!
আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলুম না, বললুম, ‘তবে যাই পরি!’
অশ্রুবিকৃত কণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘আহ্, তাই যাও!’
কিন্তু জ্যোৎস্না-বিবশা নিশীথিনীর মতোই যেন তার চরণ অবশ হয়ে উঠেছিল, তাই কুণ্ঠিত অবগুণ্ঠিত বদনে সে পাথরের মতো সেইখানে দাঁড়িয়েই রইল। যখন দেখলুম হেমন্তে শিশির-পাতের মতো তার গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, তখন অতি কষ্টে আমার এক বুক দীর্ঘশ্বাস চেপে চলে এলুম। তখন তীক্ষ্ণ ক্লেশের চোখা বাণ আমার বাইরে ভিতরে এক অসহনীয় ব্যথার সৃষ্টি করছিল। মনে হচ্ছিল, এই চাঁদিমা-গর্বিত যামিনীর সমগ্র বক্ষ ব্যেপে সাহানা সুরের পাষাণ-ফাটা কান্না আকণ্ঠ ফুঁপিয়ে উঠছে, আর তাই সে শুধু সিক্ত চোখে মৌন মুখে আকাশ-ভরা তারার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, আকাশের মতো আমারও মর্ম ভেদ করে এমনই তো কোটি কোটি আগুন-ভরা তারা জ্বলছে, উষ্ণতায় সেগুলো মার্তণ্ডের চেয়েও উত্তপ্ত। স্থির সৌদামিনীর মতো সেগুলো শুধু জ্বালাময়ী প্রখর তেজে জ্বলছে – ধু-ধু-ধু!
* * *
এটাও একবার কিন্তু মনে হয়েছিল সে দিন যে, আহ, কী হতভাগা আমি! যা পেয়েছিলাম, তাতেই সন্তুষ্ট থাকলুম না কেন, তাকে দেখতে পেয়েই পালিয়ে এলুম না কেন?
দূরে ওই একটু অনুরাগ সঞ্চিত সলাজ চাউনি, – নানান কাজের অনর্থক ব্যস্ততার আড়ালে দু-তিন বার দৃষ্টি-বিনিময়, হঠাৎ একটি শিহরণ ভরা পরশ, – যাই-যাই করেও না যেতে পারার মাধুরীময় সলজ্জ কুণ্ঠা, মুখর হাসি ওষ্ঠ-অধরের নিষ্পেষণে চাপতে গিয়ে চোখের তারায় ফুটে ওঠা, আর সেই শরমে কর্ণমূলটি আরক্ত হয়ে ওঠা – এই সব ছোটোখাটো পাওয়া আর টুকরো টুকরো আনন্দের গাঢ় অনুভূতি আমার প্রাণে যে এক নিবিড় মাধুরীর মাদকতা ঢেলে নেশায় মশগুল করে রেখেছিল, তার চেয়েও বেশি আমি তো আর পেতে চাইনি, তবে কেন সে আমায় এমন অপমান করলে?
আমি তাকে ভালোবেসে আসছি, সে-যে কবে থেকে তার কোনো দিন-ক্ষণ মনে নেই; বড়ো প্রাণ দিয়েই ভালোবেসেছি তাকে, কিন্তু কোনো দিন কামনা করিনি। আগেও মনে হত আর আজও হয় যে, তাকে না পেয়ে আমার জীবনটা ব্যর্থই হয়ে গেল, তবু প্রাণ ধরে কোনো দিনই তো তাকে কামনা করতে পারিনি। বরং যখনই ওই বিশ্রী কথাটা – মিলন আর পাওয়ার এবড়ো-খেবড়ো দিকটা, একটুখানির জন্যে মনের কোণে উঁকি মেরে গিয়েছে, তখনই যেন লজ্জায় আর বিতৃষ্ণায় আমার বুক এলিয়ে পড়েছে । এত ভুবন-ভরা ভালোবাসা আমার কি শেষে দুদিনেই বাসি হয়ে পড়তে দেব? – ছি ছি! না না!
সেদিন মনে হয়েছিল, যে ভালোবাসা দুজনের দেহকে দুদিক থেকে আকর্ষণ করে মিলিয়ে দেয়, সে তো ভালোবাসা নয়, সেটা অন্য কিছু বা মোহ আর কামনা। হয়তো এই মোহটাই শেষে ভালোবাসায় পরিণত হতে পারত এমনই দূরে দূরেই থেকে, কিন্তু এক নিমিষের মিলনেই সে পবিত্র ভালোবাসা কেমন বিশ্রী কদর্যতায় ভরে গেল! প্রেমের মিলন তো এত সহজে এমন বিশ্রী হয় না! তাই জীবন আমার ব্যর্থ হবে জেনেও আমি প্রাণ থাকতে তার সঙ্গে মিলিনি। জীবনভরা দুঃখ আর ক্লেশ-যাতনা অপমানের পসরা মাথা পেতে নিয়েছি, তবু আমি ভুলেও ভাবতে পারিনি যে, এমনই নির্লজ্জের মতো এসে এই আঁধারে-পথের মামুলি মিলনে আমার প্রিয়ার অবমাননা করি। আমি জানি, এমন করেই তাকে এমন করে পাব, যে-পাওয়া সকলে পায় না। কেউ বলে না দিলেও আমার বিশ্বাস আছে যে, আজ যাকে ব্যর্থ বলে মনে করছি, আমার জীবনে সেই ব্যর্থতাই একদিন সার্থকতায় পুষ্পিত পল্লবিত হয়ে উঠবে – …আ মলো, – কী লিখতে গিয়ে কী সব বাজে কথা লিখছি! হাঁ, কী বলছিলুম? তাকে ভালোবাসি বলেই তাকে এমন করে এড়িয়ে এলুম, এই কথাটা বুঝতে না পেরেই কী সে আমায় এমন করে প্রত্যাখ্যান করলে! – হায়! প্রাণ প্রিয়তমের পাওয়াকে এড়িয়ে চলবার ধৈর্য আর শক্তি পেতে যে আমি কত বেশি বেদনা আর কষ্ট পেয়েছি, তা তুমি বুঝবে না পরি – বুঝবে না! তবু কিন্তু বড়ো কষ্ট রয়ে গেল যে, হয়তো তুমি আমার ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে পারলে না। তোমায় অন্যকে বিলিয়ে দিয়ে তোমায় যত বেদনা দিয়েছি, তার চেয়ে কত বেশি ব্যথা যে আমাকে চাপতে হয়েছে, কতো বড়ো কষ্ট যে নীরবে সইতে হয়েছে, তা যদি তুমি জানতে পারতে পরি, তাহলে সেদিন এই কথাটা মনে করে আমায় এতো বড়ো আঘাত করতে পারতে না।…