আচ্ছা, বাইরে আমি এতটা নিষ্করুণ নির্মম হলেও আমার যে এই মরু-ময়দানের শুকনো বালির নীচে ফল্গুধারার মতো অন্তরের বেদনা, তার জন্যে করুণায় একটি আঁখিও কি সিক্ত হয় না? এতই অভিশপ্ত বিড়ম্বিত জীবন আমার! হয়তো থাকতেও পারে। তবু চাই নে যে? – না ভাই, না, প্রত্যাখ্যান আর বিদ্রুপের ভয় ও বেদনা যে বড়ো নিদারুণ! তাই আমার অন্তরের ব্যথাকে আর লজ্জাতুর করতে চাই নে – চাই নে। হয়তো তাতে সে কোন্ এক পবিত্র স্মৃতির অবমাননা করা হবে। সে তো আমি সইতে পারব না। – অথচ একটু সান্ত্বনা যেন এ নিরাশ নীরস জীবনে খুবই কামনার জিনিস হয়ে পড়েছে। এখন আমার সান্ত্বনা হচ্ছে এই লিখেই – এমনি করে আমার এই গোপন খাতাটির সাদা বুকে তারই – সেই বেদনাতুর মূর্তিটিরই প্রতিচ্ছবি আবছায়ায় এঁকে। আমার সাদা খাতার এই কালো কথাগুলি আর গানের স্নিগ্ধ-কল্লোল এই দুটি জিনিসই আমার আগুন-ভরা জীবনে সান্ত্বনা-ক্ষীর ঢেলে দিচ্ছে আর দেবে!…
আমার আজ দুনিয়ার কারুর উপর অভিমান নেই! আমার সমস্ত মান-অভিমান এখন তোমারই উপর খোদা! তুমিই তো আমায় এমন করে রিক্ত করেছ, তুমিই যে আমার সমস্ত স্নেহের আশ্রয়কে ঝড়ো-হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সারা বিশ্বকে আমার ঘর করে তুলছ, – এখন পর হলে চলবে না – এড়িয়ে যেতেও পারবে না। এখন তুমি না সইলে এ দুরন্তের আবদার অত্যাচার কে সইবে বল? ওগো আমার দুর্জ্ঞেয় মঙ্গলময় প্রভু, এখন তুমিই আমার সব! –
* * *
হাঁ, এখনই লিখে থুই, নইলে কে জানে কোন্ দিন দুশমনের শেলের একটা তীব্র আঘাত ক্ষণিকের জন্যে বুকে অনুভব করে চিরদিনের মতো নিথর-নিঝুম হয়ে পড়ব! এই মহাসমরসাগরে ছোট্ট এক বুদ্বুদের মতোই মাথা তুলে উঠেছি, আবার হয়তো এক পলকেই আমার ক্ষুদ্র বুকের সমস্ত আশা-উৎসাহ ব্যথা-বেদনা থেমে গিয়ে ওই বুদ্বুদটির মতোই কোথায় মিলিয়ে যাব। কেউ আহা বলবে না – কেউ উহুঁ করবে না! আমার কাছে সেই মৃত্যুর চিন্তাটা কেমন একরকম প্রশান্ত মধুর!
আর একটা কথা, – আমাকে কিন্তু বাইরে এখনকার মতোই এমনই রণদুর্মদ, কর্তব্যের সময় এমনই মায়া-মমতাহীন ক্রূর সেনানী, যুদ্ধে সমুদ্রের উচ্ছ্বাসের চেয়েও দুর্বিনীত দুর্বার নররক্তপিপাসু দুর্বৃত্ত দানবের মতোই থাকতে হবে। কলের মানুষের মতো আমার অধীন সৈনিকগণ যেন আমার হুকুম মানতে শেখে। আমার দায়িত্বজ্ঞানে আমার কাজে কলঙ্ক বা শৈথিল্যের যেন এতটুকু আঁচড় না পড়ে। সৈনিকের যে এর বড়ো বদনাম নেই। – তার পর কর্তব্য-অবসানেই আমি তাদের সেই চিরহাস্য প্রফুল্ল গীতিমুখর স্নেহময় ভাই! তখন আমার এই অগ্নি-উদ্গারী নয়নেই যেন স্নেহের সুরধুনী ক্ষরে, বজ্রনির্ঘোষের মতো এই কাঠচোটা স্বরেই যেন করুণা আর স্নেহ ক্ষীর হয়ে ঝরে, আমার কণ্ঠভরা গানে তাদের চিত্তের সব গ্লানি দূর হয়ে যায়! আমার অন্তর আর বাহির যেন এমন একটা অস্বচ্ছ আবরণে চির-আবৃত থাকে যে, কেউ আমার সত্যিকার কান্নারত মূর্তিটি দেখতে না পায়, হাজার চেষ্টাতেও না!
খোদা, আমার অন্তরের এই উচ্ছ্বসিত তপ্তশ্বাস যেন আনন্দ-পুরবির মুখরতানে চিরদিনই এমনই ঢাকা পড়ে যায়, শুধু এইটুকুই এখন তোমার কাছে চাইবার আছে। আর যদি এই অজানার অচিন ব্যথায় কোনো অবুঝ হিয়া ব্যথিয়ে ওঠে, তবে সে যেন মনে মনে আমার প্রার্থনায় যোগ দিয়ে বলে, – ‘আহা, তাই হোক!’ কেননা এমনিতর স্নেহ-কাঙাল, যারা, – যাদের মৃত্যুতে এক ফোঁটা আঁসু ফেলবারও কেউ নেই এ দুনিয়ায়, যারা কারুর দয়া চায় না, অথচ এক বিন্দু স্নেহ-সহানুভূতির জন্যে উদ্বেগ-উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকে, – তাদের দেওয়ার এর বেশি কিছু নেই, আর থাকলেও তারা তা চায়ও না। এই একটু স্নিগ্ধ বাণীই গুহার ম্লান বুকে জ্যোৎস্নার শুভ্র আলোর মতো তাদের সান্ত্বনা দেয়।
* * *
সে ছিল এমনই এক চাঁদনী-চর্চিত যামিনী, যাতে আপনি দয়িতের কথা মনে হয়ে মর্মতলে দরদের সৃষ্টি করে! মদির খোশ-বুর মাদকতায় মল্লিকা-মালতীর মঞ্জুল মঞ্জরিমালা মলয় মারুতকে মাতিয়ে তুলেছিল। উগ্র রজনিগন্ধার উদাস সুবাস অব্যক্ত অজানা একটা শোক-শঙ্কায় বক্ষ ভরে তুলেছিল। … সে এল মঞ্জীর-মুখর-চরণে সেই মুকুলিত লতাবিতানে! তার বাম করে ছিল চয়িত ফুলের ঝাঁপি। কবরী-ভ্রষ্ট আমের মঞ্জরি শিথিল হয়ে তারই বুকে ঝরে ঝরে পড়ছিল, ঠিক পুষ্প-পাপড়ি বেয়ে পরিমল ঝরার মতো। কপোল-চুম্বিত তার চূর্ণকুন্তল হতে বিক্ষিপ্ত কেশর-রেণুর গন্ধ লুটে নিয়ে লালস-অলস ক্লান্ত সমীর এরই খোশ খবর চারিদিকে রটিয়ে এল, – ওগো ওঠো, দেখো ঘুমের দেশ পেরিয়ে স্বপ্ন-বধূ এসেছে!’ উল্লাস-হিল্লোলে শাখায় শাখায় ঘুমন্ত ফুল দোল খেয়ে উঠল! আমার কপালে ঘাম ভরে উঠল, বক্ষ দুরু দুরু করে কাঁপিয়ে গেল সে কোন্ বিবশ শঙ্কা। ঘন ঘন শ্বাস পড়ে আমার হাতের কামিনী-গুচ্ছটির দলগুলি খসে খসে পড়তে লাগল। আমার বোধ হল, এ কোন্ ঘুমের দেশের রাজকন্যা আমার কিশোরী মানস-প্রতিমার পূর্ণ পরিণতির রূপে এসে আমার চোখে স্বপ্নের জাল বুনে দিচ্ছে! ভয়ে ভয়ে আমার আবিষ্ট চোখের পাতা তুলেই দেখতে পেলুম, বেতস লতার মতো সে আমার সামনে অবনত মুখে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। আমাকে চোখ মেলে চাইতে দেখে যেন সে চলে যেতে চাইল। আমি তাড়াতাড়ি ভীত জড়িত স্বরে বললুম, – ‘কে তুমি – পরি?’