আমি সেদিন এই একটা নতুন জিনিস দেখেছিলাম যে, যতদিন সে কারুর ভালোবাসা পায়নি, ততদিন তার সারা জনমের চাপা অভিমান এমন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেনি; কিন্তু যেই সে বুঝলে, কেউ তাকে ভালোবেসেছে, অমনি তার কান্না-ভরা অভিমান ওই স্নেহের আহ্বানে দুর্জয় বেগে হাহাকার করে গর্জন করে উঠল। এই ফেনিয়ে-ওঠা অভিমানের জন্যেই সে যাকে ভালোবাসে, তাকে এড়িয়ে গেল। এমন ভালোবাসায় যে প্রিয়তমাকে এড়িয়ে চলাতেই আনন্দ। এ বেদনা-আনন্দের মাধুরী আমার মতো আর কেউ বোঝেনি।
হায়, আমার মনের এত কথা বুঝি মনেই মরে গেল। এ জীবনে আর তা বলা হবে না।
* * *
[চির-জনমের ছাড়াছাড়ি]
তার পর-বছরের কথা।
কাজরিয়ার সঙ্গে আবার আমার দেখা হল মির্জাপুরের পাহাড়ের বুকে বিরহী নামক উপত্যকায়। সেদিন ছিল ভাদ্রের কৃষ্ণা-তৃতীয়া। সেদিনও মেঘে আঁধারে কোলাকুলি করছিল। সেদিন ছিল কাজরি উৎসবের শেষ দিন। সেদিন বাদল মেঘ ধানের খেতে তার শেষ বিদায়-বাণী শোনাচ্ছিল, আর নবীন ধানও তার মঞ্জরি দুলিয়ে কেঁপে কেঁপে বাদলকে তার শেষ অভিনন্দন জানাচ্ছিল। হায়, এদের কেউ জানে না, আবার কোন্ মাঠে কোনো তালি-বনের রেখা-পারে তাদের নতুন করে দেখাশোনা হবে। আজ সুন্দরীদের চোখের কাজল মলিন, তাদের সুরে কেমন একটা ব্যথিত ক্লান্তি, সুন্দর ছোট্ট মুখগুলি রোদের তাপে শালের কচি পাতার মতো ম্লান – এলানো! কাল যে এই সারা-বছরের চাওয়া বাদল-উৎসবের বিসর্জন, এইটাই তাদের এত আনন্দকে বার-বারে ব্যথা দিয়ে যাচ্ছিল। কে জানে, তাদের এই সব সখীদের এমনি করে পর-বছর আবার দেখা হবে কি না। হয়তো এরই মাঝের কত চেনা মুখ কোথায় মিলিয়ে যাবে, সারা দুনিয়া খুঁজেও সে মুখ আর দেখতে পাবে না।
দোলনার সোনালি রং-এর ডোরকে উজ্জ্বলতর করে বারে বারে ছুরি-হানার মতো বিজুরি চমকে যাচ্ছিল। কাজরি ছুটে এসে আমার ডান হাতটি তার দু হাতের কোমল মুঠির মধ্যে নিয়ে বুকের উপর রাখলে, তার পর বললে, – ‘ওগো পরদেশি শ্যামল, তোমায় আমি চিনেছি। তুমি সত্য। তুমি আমায় ভালোবাস। নিশ্চয়ই ভালোবাস। সত্যি ভালোবাস।’ দেখলাম, তার শীর্ণ চোখের উজ্জ্বল চাউনিতে গভীর ভালোবাসার ছল-ছল জ্যোতি শরৎপ্রভাতের জল-মাখা রোদ্দুরের মতো করুণ হাসি হেসেছে। আহ, এত দিনের বিরহের কঠোর তপস্যায় সে তার সত্যকে চিনতে পেরেছে। তার খিন্ন মলিন তনুলতার দিকে চেয়ে চেয়ে আমার চোখের জল সামলানো দায় হয়ে উঠল। এক বিন্দু অসংবরণীয় অবাধ্য অশ্রু তার পাণ্ডুর কপোলে ঝরে পড়তেই সে আমার পানে আর্ত দৃষ্টি হেনে ওইখানেই বসে পড়ল! বকুল-শাখা আর শিউলি পাতা তার মাথায় ফুল-পাতা ফেলে সান্ত্বনা দিতে লাগল।
মতিয়া বললে, আবারও সে অনেক আশা করে আগের বছরের মতোই শ্রাবণ-পঞ্চমীর ভোরে কাজরি গেয়ে যমুনা-সিনানে গিয়ে সেখানকার মাটি দিয়ে ধানের অঙ্কুর উদ্গম করেছিল। সেই অঙ্কুরগুলি সে নিবিড় যতনে তার ছিন্ন ভেজা ওড়না দিয়ে আজও ঢেকে রেখেছে। সে রোজই বলত – ‘মতিয়া রে, এবার আমার পরদেশি বঁধু আসবে। ওই যে শুনতে পাচ্ছি তার পথিক-গান।’
আজ ভাদ্র-তৃতীয়াতে ‘নবীন ধানের মঞ্জরি’ নিয়ে কতকগুলি সে দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে এসেছে, আর কয়েকটি শিষ এনেছে আমাকে উপহার দিতে। …
আমি তার হাতে নাড়া দিয়ে বললাম, ‘কাজরি, আর আমাকে ছেড়ে যেও না।’
শুষ্ক অধর-কোণে তার আধ টুকরো ম্লান হাসি ফুটতে ফুটতে মিলিয়ে গেল। সে অতি কষ্টে তার আঁচল থেকে বহু যত্নে রক্ষিত ধানের সবুজ শিষ কটি বের করে একবার তার দুটি জল-ভরা চোখের পূর্ণ চাওয়া দিয়ে আমার পানে চেয়ে দেখলে, তার পর আমার স্কন্ধদেশে ক্লান্ত বাহু দুটি থুয়ে আমার কর্ণে শিষগুলি পরিয়ে দিলে। একটা গভীর তৃপ্তির দীঘল শ্বাসের সঙ্গে পবিত্র একরাশ হাসি তার চোখে মুখে হেসে উঠল। দেখে বোধ হল, এমন প্রাণ-ভরা সার্থক হাসি সে যেন আর জন্মে হাসেনি। আবার একটু পরেই কী মনে হয়ে তার সারা মুখ ব্যথায় পাণ্ডুর হয়ে উঠল। সহসা চিৎকার করে সে কয়ে উঠল, – ‘না শ্যামল, না – আমাকে যেতেই হবে। তোমার এই বুকভরা ভালোবাসার পরিপূর্ণ গৌরব নিয়ে আমায় বিদায় নিতে দাও।’
কোলের উপর তার শ্রান্ত মাথা লুটিয়ে পড়ল। চির-জনমের কামনার ধনকে আমার বুকের উপর টেনে নিলাম। আকুল ঝঞ্ঝা উন্মাদ বৃষ্টিকে ডেকে এনে আমায় ঘিরে আর্তনাদ করে উঠল, ওহ! – ওহ! – ওহ।
আমার মনে হয়, চাওয়ার অনেক বেশি পাওয়ার গর্বই তাকে বাঁচতে দিলে না, সে মরণ-ত্যাগী হয়ে তার কালো রূপস্রষ্টার কাছে চলে গেল। এবার বুঝি সে অনন্ত রূপের ডালি নিয়ে আর এক পথে আমার অপেক্ষায় বসে থাকবে। … কালো মানুষ বড্ডো বেশি চাপা অভিমানী। তাদের কালো রূপের জন্যে তারা মনে করে, তাদের কেউ ভালোবাসতে পারে না। কেউ ভালোবাসছে দেখলেও তাই সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। বেচারাদের জীবনের এইটাই সবচেয়ে বড়ো ট্র্যাজেডি।
* * *
[বাদল-ভেজা তারই স্মৃতি]
এ বছরও তেমনই শাঙন এসেছে। আজও আমার সেই প্রথম-দিনে-শোনা কাজরি গানটি মনে পড়ছে, – ‘ওগো শ্যামল, তোমার ঘোমটা খোলো।’
হায় রে পরদেশি সাঁবলিয়া। তোমার এ অবগুণ্ঠন আর এ জীবনে খুলল না, খুলবে না। …
আজ যখন আমার ক্লান্ত আঁখির সামনে আকাশ-ভাঙা ঢেউ ভেঙে ভেঙে পড়ছে, পূরবী-বায় হুহু করে সারা বিশ্বের বিরহ-কান্না কেঁদে যাচ্ছে, নিরেট জমাট আঁধার ছিঁড়ে ঝড়ের মুখে উগ্র মল্লারের তীব্র গোঙানি ব্যথিয়ে ব্যথিয়ে উঠছে, – ওগো, সামনে আমার পথ নেই – পথ নেই। অনন্ত বৃষ্টির আকুল ধারা বইছে। – এমন সময় কোথায় ছিলে ওগো প্রিয়তম আমার। এ বছরের মেঘ-বাদলে এমন করে আমায় যে দেখা দিয়ে গেলে, আমার প্রাণে যে কথা কয়ে গেলে! হারানো প্রেয়সী আমার! তোমার কানে-কানে-বলা গোপন গুঞ্জন আমি এই বাদলে শুনেচি, শুনেচি। এই তোমার টাটকা-ভাঙা রসাঞ্জনের মতো উজ্জ্বল-নীল গাঢ় কান্তি। ওগো, এই তো তোমার কাজল-কালো স্নিগ্ধ-সজল রূপ আমার চোখে অঞ্জন বুলিয়ে গেল! ওগো আমার বারে-বারে-হারানো মেঘের দেশের চপল প্রিয়! এবার তোমায় অশ্রুর ডোরে বেঁধেছি। এবার তুমি যাবে কোথা? লোহার শিকল বারে-বারে কেটেছ তুমি মুক্ত-বনের দুষ্ট পাখি, তাই এবার তোমায় অশ্রুর বাঁধনে বেঁধেছি, তাকে ছেদন করা যায় না! ওই ঘন নীল মেঘের বুকে, এই সবুজ-কচি দুর্বায়, ভেজা ধানের গাছের রঙে তোমায় পেয়েছি। ওগো শ্যামলি! তোমার এ শ্যামশোভা লুকাবে কোথায়? ওই সুনীল আকাশ এই সবুজ মাঠ, পথহারা দিগন্ত, – এতেই যে তোমার বিলিয়ে-দেওয়া চিরন্তন শ্যামরূপ লুটিয়ে পড়ছে। তাই আজ এই শ্রাবণ-প্রাতে ধানের মাঝে বসে গাইছি, –