হিন্দোলার কিশোরীরা গাচ্ছিল কাজল-মেঘের আর নীল আকাশের গান। নীচে শ্যামল দুর্বায় দাঁড়িয়ে বিনুনি-বেণি-দোলানো সুন্দরীরা মৃদঙ্গে তাল দিয়ে গাচ্ছিল কচি ঘাসের আর সবুজ ধানের গান। তাদের প্রাণে মেঘের কথার ছোঁয়া লেগেছিল। … মেঘের এই মহোৎসব দেখে আপনি আমার চোখে জল ঘনিয়ে এল। দেখলাম সেই কালো কাজ্রিয়া – দোলনা ছেড়ে আমার পানে সজল চোখের চেনা চাউনি নিয়ে চেয়ে আছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই সে এক নিমেষে দোলনায় উঠে কয়ে উঠল, – সজনিয়া গে, ওহি সুন্দর পরদেশিয়া। তার সই মতিয়া দুলতে দুলতে বাদল-ধারায় এক রাশ হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলল, –‘হা রে কাজরিয়া, তুহার সাঁবলিয়া!’
কাজরিয়া মতিয়ার চুল ধরে টেনে ফেলে দিয়ে পাশের বকুল গাছটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।
আমি ভাবছিলাম, এমনি করেই বুঝি মেঘে আর মানুষে কথা কওয়া যায় – এমনি করেই বুঝি ও-পারের বিরহী যক্ষ মেঘকে দূতী করে তার বিচ্ছেদ-বিধুরা প্রিয়তমাকে বুকের ব্যথা জানাত। আমার ভেজা-মন তাই কালো মেঘকে বন্ধু বলে নিবিড় আলিঙ্গন করলে!
চমকে চেয়ে দেখলাম, সে কখন এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। তার গভীর অপলক দৃষ্টি মেঘ পেরিয়ে কোন্ অনন্তের দিগ্বলয়ে পৌঁছেছিল, সেই জানে। তার পাশে থেকে আমারও মনে হল ওই দূর মেঘের কোলে গিয়ে দাঁড়িয়েছি শুধু সে আর আমি। কেউ কোথাও নেই, উপরে নীচে আশে-পাশে শুধু মেঘ আর মেঘ, – সেই অনন্ত মেঘের মাঝে সে মেঘের-বরণ বাহু দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে তার মেঘলা-দৃষ্টিখানি আমার মুখের উপর তুলে ধরেছে। ওইখানেই – ওই চেনা-শোনা জায়গাটিতেই যেন আমাদের প্রথম দেখা-শোনা, ওইখানেই আবার আমাদের অভিমানের ছাড়াছাড়ি, এই কথাটি আমাদের দুই জনেরই মনের অচিন কোণে ফুটে উঠতেই আমরা একান্ত আপনার হয়ে গেলাম। যে কথাটি হয়তো সারা জীবন চোখের জলে ভেসেও বলা হত না, এই ঝড়-বৃষ্টির মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক নিমেষে চারটি চোখের অনিমিখ চাউনিতে তা কওয়া হয়ে গেল।
আমি বললাম – ‘কাজরি, আমি অনেক জীবনের খোঁজার পর তোমায় পেয়েছি!’ এই মেঘের ঝরায় যে প্রাণের কথা প্রাণ দিয়ে সে শুনছিল, সহসা তাতে বাধা পেয়ে সে সচেতন হয়ে উঠল। চখা হরিণীর মতো ভীত-ত্রস্ত চাউনি দিয়ে চারিদিকে চেয়ে আচমকা আর্ত আকুল স্বরে সে কেঁদে উঠল। সে আর দাঁড়াল না, হুঁকরে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিলে। যেতে যেতে বলে গেল –‘নহি রে সুন্দর পরদেশি ম্যয় কারী কাজরিয়া হুঁ – ‘ওগো সুন্দর বিদেশি, আমি কালো।’ আরও কী বলতে বলতে অভিমানে ক্ষোভে তার মুখে আর কথা ফুটল না, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল!
একটি পুরো বছর আর তার দেখা পাইনি।
আজ শাঙন রাতের মাতামাতিতে হৃদয় আমার কথায় আর ব্যথায় ভরে উঠেছে, আর তার সেই বিদায়-দিনের আরও অনেক কিছু মনে পড়ছে। আজ আমার শিয়রের ক্ষীণ দীপশিখাটিতে বাদল-বায়ের রেশ লেগে তাকে কাঁপিয়ে তুলছে, আমার বিজন কক্ষটিতে সেই কাঁপুনি আমার মনে পড়িয়ে দিচ্ছে – হায়, আজ তেমন করে আঘাত দেবারও আমার কেউ নেই। প্রিয়তমের কাছ থেকে আঘাত পাওয়াতে যে কত নিবিড় মাধুরী, তা বেদনাতুর ছাড়া কে বুঝবে? যার নিজের বুকে বেদনা বাজেনি, সে পরের বেদন বুঝবে না, বুঝবে না…
সে বলেছিল, – ‘দেখ বিদেশি পথিক। আমি নিবিড় কালো, লোকে তাই আমাকে কাজরিয়া বলে উপহাস করে; তাদের সে আঘাত আমি সইতে, উপেক্ষা করতে পারি, আমার সে সহ্যশক্তি আছে, কিন্তু ওগো নিষ্ঠুর! তুমি কেন আমায় ভালোবাসি বলে উপহাস করছ? ওগো সুন্দর শ্যামল। তুমি কেন এ হতভাগিনিকে আঘাত করছ? এ অপমানের দুর্বার লজ্জা রাখি কোথায়? জানি, আমি কালো কুৎসিত, তাই বলে ওগো পরদেশি, তোমার কী অধিকার আছে আমাকে এমন করে মিথ্যা দিয়ে প্রলুব্ধ করবার? ছি, ছি, আমায় ভালোবাসতে নেই – ভালোবাসা যায় না, ভালোবাসতে পারবে না। এমন করে আর আমায় দুর্বলতায় বেদনা-ঘা দিয়ো না শ্যামল, দিয়ো না! ও তো আমার অপমান নয়, ও যে আমার ভালোবাসার অপমান; তা কেউ সইতে পারে না। – বিদায় শ্যামল, বিদায়!’
আমি মনে মনে বললাম, – ওগো অভিমানিনী। অভিমানের গাঢ় বিক্ষোভ তোমায় অন্ধ করেছে, তাই তুমি সকল কথা বুঝেও বুঝছ না। আমিও যে তোমারই মতো কালো। তুমি তো নিজ মুখেই আমায় শ্যামল বলেছ, অথচ সুন্দর বলছ কেন? তোমার চোখে তুমি আমায় যেমন সুন্দর দেখেছ, আমার চোখে আমিও তেমনই তোমার সৌন্দর্য দেখেছি। তোমার ওই কালো রূপেই আমার চির-আকাঙ্ক্ষিতাকে খুঁজে পেয়েছি, যেন সে কোন্ অনাদি যুগের অনন্ত অন্বেষণের পর! আর যদি অধিকারই না থাকে, তবে তুমি আর কারুর আঘাতে বেদনা পেলে না, অথচ আমার স্নেহ সইতে পারলে না কেন? আমারই উপরে বা তোমার কী দাবি পেয়েছ, যার জোরে সবারই আঘাত-বেদনাকে উপেক্ষা করতে পার, শুধু আমাকেই পার না? আমার বক্ষ দলিত করে কী করে আমায় এমন ছেড়ে যেতে পারছ? যার ভালবাসায় বিশ্বাস নেই, তার উপর তো অভিমান করা চলে না। যাকে বুঝি, আর আমার দাবি আছে যে, আমার অভিমান এ সহ্য করবে, তার উপর অভিমান আসে, তারই উপর রাগ করা যায়। আমার যে তখন মস্ত বিশ্বাস থাকে যে, আমার এ অহেতুক অভিমানের আব্দার এ সহ্য করবেই – কেননা, সে যে আমায় ভালোবাসে।
সে কোনো কথা বুঝল না, চলে গেল। এ তীব্র অভিমান যে তার কার উপর, নিজেই বলতে পারত না, তবে কতকটা যেন তার এই কালো রূপের স্রষ্টার উপর। তার বুক-ভরা অভিমান আহত পক্ষী-শাবকের মতো যেন সেই দুর্বোধ্য রূপস্রষ্টার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলেছিল, – ওগো, আমাকেই কি সারা দুনিয়ার মাঝে এমন করে কালো কুৎসিত করে সৃষ্টি করতে হয়? তোমার কুম্ভ-ভরা রূপের একটি রেণু এ-অভাগিকে দিলে কি তোমার ভরা-কুম্ভ খালি হয়ে যেত? যদি কালো করেই সৃষ্টি করলে তবে ওই অন্ধকারের মাঝে আলোর মতো ভালোবাসা দিলে কেন? আবার অন্যেরে দিয়ে ভালোবাসিয়ে লজ্জিত কর কেন? … হায়, সে যে কখনও বোঝেনি যে, সত্য-সৌন্দর্য বাইরে নয়, ভিতরে – দেহে নয়, অন্তরে।