এ কোন্ চির-পরিচিত স্বর? এ কে ছলনা করে আমায়? পূবের হাওয়া আমার পাশ দিয়ে কেঁদে গেল – ‘হায় গৃহহীন, হায় পথহারা!’ ঝড়ে-ওড়া এক দল পলকা মেঘের মতো মল্লারের সুরে পথের আকাশ-বাতাস ভরিয়ে কাজরি গায়িকা রূপসিরা গেয়ে যাচ্ছিল, – ‘ঘুঙঘট-পট খোলো আরে সাঁবলিয়া!’ (ওগো শ্যামল, এখন তোমার ঘোমটা খুলে ফেল।)
আমার কাছে তাকে এমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তরুণীরা আঁখির পলকে থমকে দাঁড়াল, তারপর চুল ছড়িয়ে বাহু দুলিয়ে আঁচল উড়িয়ে বলে উঠল, – ‘কাজরিয়া গে! ক্যা তোরি সাঁবলিয়া আ গয়ি?’
সে তাদের এক পাশে সরে গিয়ে কাঁপা-গলায় বললে, – ‘নহি রে সজনিয়া, নহি! য়্যে পরদেশি জোয়ান –’
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আর একজন বলে উঠল, – ‘ক্যা তেরি দিল্ ছিন্ লিয়া?’
সে লজ্জায় আর দাঁড়াতে পারল না, খামখা আমার দিকে অনুযোগ-তিরস্কার-ভরা বাঁকা চাউনি হেনে চলে গেল!
পথের ওই বাঁক থেকেই অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল তাদের ধানি রং-এর শাড়ির ঢেউ আর আশমানী রং-এর ওড়নার আকুল প্রান্ত। রয়ে রয়ে তাদের এলানো কেশপাশ বেয়ে কেমন মধুর এক সোঁদা-গন্ধ ভেসে আসছিল। অতগুলি সুন্দর মুখের মাঝ থেকে আমার মনে জগজগ করছিল শুধু ওই কাজরিয়ার ছোট্ট কালো মুখ, – যা শিল্পীর হাতে কালো পাথর-কোঁদা দেবীমুখের মতো নিটোল! বিজলি-চমকের মতো তার ওই যে একটি দুরন্ত চপল গতি, তারই মধুরতাটুকু আমার মনের মেঘে বারে-বারে তড়িৎ হেনে যাচ্ছিল।
পথের পাশের দোলনা-বাঁধা দেবদারু-তলায় দাঁড়িয়ে আমার শুধু এই কথাটি মনে হতে লাগল, এই এক পলকের আধখানি চাওয়ায় কেমন করে মানুষ এত চিরপরিচিত হয়ে যেতে পারে।
* * *
[অভিমানের দেখা-শোনা]
তার পরের দিন আমলকি বনে দাঁড়িয়ে সেই আগেকার দিনের কথাটাই ভাবছিলাম, – আচ্ছা, এই যে আমার মানসী বঁধু, – একে কবে কোন্ পুরবির কান্না-ভরা খেয়ার পারে হারিয়ে এসেছিলাম? সকল স্মৃতি উলট-পালট করেও তার দিন ক্ষণ মনে আসি-আসি করেও যেন আসে না, অথচ মনের মানুষ আমার একে দেখেই কেমন করে চিনে ফেললে। তাই সে আমার আঁখির দীপ্তিতে ফুটে উঠে বলে উঠল, – এই তো আমার চির-জনমের চাওয়া তুমি! ওগো, এই তো আমার চির-সাধনার ধন তুমি! …
আর একবার আমার স্মৃতির অতল তলে ডুব দিলাম, এমন সময় ঝড়ের সুরে কাজরি গান গাইতে রূপসি নাগরীরা আমার পাশ দিয়ে উধাও হয়ে গেল, –
চঢ়ে ঘটা ঘন ঘোর গরজ রহে বদরা রে হোরি।
রিম ঝিম রিম ঝিম পানি বরষৈ রহি রহি জিয়া ঘাবরাবৈ রামা।
বহৈ নয়নাসে নীর ময়েল ভয়ি কজরা রে হোরি!
[ঘোর ঘটা করে গগনে মেঘ করেচে, বাদল গরজন করছে, রিম-ঝিম-রিম-ঝিম বৃষ্টি ঝরচে, থেকে থেকে জান আমার ঘাবড়িয়ে উঠছে, নয়ন বেয়ে আঁসু ঝরছে; – ওগো, চোখের কাজল আমার মলিন হয়ে গেল!]
বর্ষার মেঘ চলে গেল। মর্মে আমার তারই গাঢ় গমক গুমরে ফিরতে লাগল, – ‘ময়েল ভয়ি কজরা রে হোরি!’ – ওগো প্রিয়, চোখের কাজল আমার মলিন হয়ে গেল! সে কোন্ অচেনার উদ্দেশ্যে এ অবুঝ-কান্না তোমার বিদেশিনি? সে-কথা সেও জানে না, তার মনও জানে না! …
আবার সেই সন্তাপহারী আমার চিরবাঞ্ছিত মেঘ-গুরু-গরজনে ডেকে উঠল। বনের সিক্ত আকাশকে ব্যথিয়ে ময়ূরের কেকা-ধ্বনির সাথে চাতকের অতৃপ্তির কাঁদন রণিয়ে রণিয়ে উঠছিল, – ‘দে জল, দে জল!’ হায় রে চিরদিনের শাশ্বত পিয়াসী! তোর এ অনন্ত পিয়াসা কি সারা সাগরের জলেও মিটল না? আমার কেমন আবছা এক কণা স্মৃতি মনের কানে বলছিল, – ‘তুমি আগে এমনই চাতক ছিলে, তোমার পিপাসা মিটবার নয়!’
ভেজা মাটির আর খস-খস-এর গুমোট-ভরা ভারী গন্ধে যেন দম আটকে যাচ্ছিল; ও-ধারে ফোটা কেয়া ফুলের, আধফোটা যূথীর, বেলির কুঁড়ির, ঝরা শেফালি-বকুলের দিল্-মাতানো খোশবুর মাঝে মাঝে পদ্ম আর কদম্বের স্নিগ্ধ সুরভি মধুর আমেজ দিচ্ছিল! বর্ষার ব্যথা আমার দিকে গভীর মৌন চাওয়া চেয়ে শুধাচ্ছিল, –
‘এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘন ঘোর বরিষায়!’
হায়, কী বলা যায়? কাকে বলা যায়? এ উতল-পাগল তার কিছুই জানে না, অথচ সে কী যেন বলতে চায় – কাকে যেন বুকের কাছে পেতে চায়! এই মেঘদূত তার কাছে তার পালিয়ে যাওয়া প্রিয়তমার সন্ধান করে গেছে, সেই চাওয়া-পাওয়াটুকুর বার্তা পৌঁছিয়ে দিয়ে গেছে, তাই সে মেঘদূতকে অভিনন্দন জানাচ্ছে –
‘এস হে সজল ঘন বাদল বরিষনে!’
আজ আর একবার মনে হল সে তার বিদায়ের দিনে বলেছিল, – ‘আবার দেখা হবে, তখন হয়তো তুমি চিনতে পারবে না!’
আজ সেই বিদায়-বাণী মনে পড়ে আমার বক্ষ কান্নায় ভরে উঠছে! আমার পাশ দিয়ে কালো কাজরিয়া যখন তার চাউনি হেনে চলে গেল, তখন ওই কথাটিই বারে বারে মনে পড়ছিল, – হয়তো তুমি চিনতে পারবে না!
তাই কাজরিয়াকে ডেকে বললাম, – ‘এই তো তোমায় চিনতে পেরেছি তোমার এই চোখের চাওয়ায়!’
কাজরিয়া চুল দিয়ে মুখ ঝেঁপে চলে গেল! তার ওই না-চাওয়াই বলে গেল, সেও আমায় চিনতে পেরেছে।…
আবার তার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। – ঝঞ্ঝার উতরোলের মতো দোল খেয়ে খেয়ে পাশের উপবন হতে তরুণী-কণ্ঠের মল্লার হিন্দোলা ভেসে আসছিল, – ‘মেঘবা ঘুম ঘুম বরষাবৈ ছাবৈ বদরিয়া শাওন মে!’
পথের মাঝে দাঁড়িয়ে দেখলাম, আকাশ বেয়ে হাজার পাগলা-ঝোরা ঝরছে – ঝম ঝম ঝম! যেন আকাশের আঙিনায় হাজার হাজার দুষ্টু মেয়ে কাঁকর-ভরা মল বাজিয়ে ছুটোছুটি করছে! তপোবনে গিয়ে দেখলাম, সেই বৃষ্টিধারায় ভিজে ভিজে মহা উৎসাহে বিদেশিনি তরুণীরা দেবদারু ও বকুল শাখায় ঝুলানো দোলনায় দোল খেয়ে খেয়ে কাজরি গাইছে। ঝড়-বৃষ্টির সাথে সে কী মাতামাতি তাদের! আজ তাদের কোথাও বন্ধন নেই, ওদের প্রত্যেকেই যেন এক একটা পাগলিনি প্রকৃতি! কী সুন্দর সেই প্রকৃতির উদ্দাম চঞ্চলতার সনে মানব-মনের আদিম চির-যৌবনের বন্ধ-হারা গতি-রাগের মিলন!–শাওন মেঘের জমাট সুরে আমার মনের বীণায় মূর্ছনা লাগল। আমার যৌবন-জোয়ারও অমনি ঢেউ খেলে উঠল। মনের পাগল অমনি করে দোদুল দোলায় দুলে সুন্দরীদের এলো চুলের মতোই হাওয়ার বেগে মেঘের দিকে ছুটল, – হায় কোথায়, কোন্ সুদূরে তার সীমা-রেখা!