আবার এইখানটাতেই, যেখানে কখনও আসব না মনে করেছিলুম, আসতে হল। এ কী নাড়ির টান! … আমার কেউ নেই, কিছু নেই, তবু কেন রয়ে রয়ে মনে হচ্ছে, – না, এইখানেই সব আছে। এ কার মূঢ় অন্ধ সান্ত্বনা? –
কারুর কিচ্ছু করিনি, আমারও কেউ কিচ্ছু করেনি, তবে কেন এখানে আসছিলুম না? – সে একটা অব্যক্ত বেদনার অভিমান, – সেটা প্রকাশ করতে পারছিনে।
হেনা! হেনা! – সাবাস! কেউ কোথাও নেই, তবুও ওধার থেকে বাতাসে ভেসে আসছে ও কী শব্দ, – ‘না,–না–না।’
পাহাড় কেটে নির্ঝরটা তেমনই বইছে, কেবল যার মেহেদি-রাঙানো পদ-রেখা এখনও ওর পাথরের বুকে লেখা রয়েছে, সেই হেনা আর নেই। এখানে ছোটো-খাটো কত জিনিস পড়ে রয়েছে, যাতে তার কোমল হাতের ছোঁয়ার গন্ধ এখনও পাচ্ছি।
হেনা! হেনা! হেনা! আবার প্রতিধ্বনি, নাঃ–নাঃ–নাঃ!
* * *
পেশোয়ার
পেয়েছি, পেয়েছি! আজ তার দেখা পেয়েছি! হেনা! হেনা! – তোমাকে আজ দেখেছি এইখানে, এই পেশোয়ারে! তবে কেন মিথ্যা দিয়ে এত বড়ো একটা সত্যকে এখনও ঢেকে রেখেছ?
সে আমায় লুকিয়ে দেখেছে আর কেঁদেছে। … কিছু বলেনি, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে আর কেঁদেছে।…
এরকম দেখায় যে অশ্রু প্রাণের শ্রেষ্ঠ ভাষা। সে আজও বললে, – ‘সে আমায় ভালোবাসতে পারেনি।…
ওই ‘না’ কথাটা বলবার সময়, সে কী করুণ একটা কান্না তার গলা থেকে বেরিয়ে ভোরের বাতাসটাকে ব্যথিয়ে তুলেছিল!
দুনিয়ার সবচেয়ে মস্ত হেঁয়ালি হচ্ছে – মেয়েদের মন!
ডাক্কা ক্যাম্প
কাবুল
যখন মানুষের মতো মানুষ আমির হাবিবুল্লাহ খাঁ শহিদ হয়েছেন শুনলুম, তখন আমার মনে হল এত দিনে হিন্দুকুশের চূড়াটা ভেঙে পড়ল! সুলেমান পর্বত জড়সুদ্ধ উখড়িয়ে গেল।
ভাবতে লাগলুম, আমার কী করা উচিত? দশ দিন ধরে ভাবলুম। বড্ড শক্ত কথা!
নাঃ, আমিরের হয়ে যুদ্ধ করাই ঠিক মনে করলুম। কেন? এ ‘কেন’র উত্তর নেই। তবুও আমি সরল মনে বলছি, ইংরেজ আমার শত্রু নয়। সে আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। যদি বলি, আমার আবার এ যুদ্ধে আসার কারণ একটা দুর্বলকে রক্ষা করবার জন্যে প্রাণ আহুতি দেওয়া, তা হলেও ঠিক উত্তর হয় না।
আমার অনেক খামখেয়ালির অর্থ আমি নিজেই বুঝি না!
সেদিন ভোরে ডালিম ফুলের গায়ে কে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল! ওঃ, সে যেন আমারই মতো আরও অনেকের বুকের খুন-খারাবি! …
উদার আকাশটা কেঁদে কেঁদে একটুর জন্যে থেমেছে। তার চোখটা এখনও খুব ঘোলা, আবার সে কাঁদবে। কার সে বিয়োগ-ব্যথায় বিধুর কোয়েলিটাও কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করঞ্জ করে ফেলেছিল, আর তার উহুঁ – উহুঁ, শব্দ প্রভাতের ভিজে বাতাসে টোল খাইয়ে দিচ্ছিল! শুকনো নদীটার ও-পারে বসে কে সানাইতে আশোয়ারি রাগিণী ভাঁজছিল। তার মিড়ে মিড়ে কত যে চাপা হৃদয়ের কান্না কেঁপে কেঁপে উঠছিল, তা সবচেয়ে বেশি বুঝছিলুম আমি। মেহেদি ফুলের তীব্র গন্ধে আমাকে মাতাল করে তুলেছিল।
আমি বললুম, – ‘হেনা, আমিরের হয়ে যুদ্ধে যাচ্ছি। আর আসব না। বাঁচলেও আর আসব না।’
সে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললে, – ‘সোহরাব প্রিয়তম! তাই যাও! – আজ যে আমার বলবার সময় হয়েছে, তোমায় কত ভালোবাসি! – আজ আর আমার অন্তরের সত্যিকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে আশেককে কষ্ট দেব না।’
আমি বুঝলুম, সে বীরাঙ্গনা, আফগানের মেয়ে। যদিও আফগান হয়েও আমি শুধু পরদেশির জীবন যাপন করেই বেড়িয়েছি, তবু এখন নিজের দেশের পায়ে আমার জীবনটা উৎসর্গ করি, এই সে চাচ্ছিল।
ওঃ, রমণী তুমি! কী করে তবে নিজেকে এমন করে চাপা দিয়ে রেখেছিলে হেনা?
কী অটল ধৈর্যশক্তি তোমার! কোমলপ্রাণা রমণী সময়ে কত কঠিন হতে পারে।…
হেনা! হেনা!!
০৭. বাদল বরিষনে
বৃষ্টির ঝম-ঝমানি শুনতে শুনতে সহসা আমার মনে হল, আমার বেদনা এই বর্ষার সুরে বাঁধা!…
সামনে আমার গভীর বন। সেই বনে ময়ূরে পেখম ধরেছে, মাথার উপর বলাকা উড়ে যাচ্ছে, ফোটা কদম ফুলে কার শিহরণ কাঁটা দিয়ে উঠছে, আর কীসের ঘন-মাতাল-করা সুরভিতে নেশা হয়ে সারা বনের গা টলছে!…
এটা শ্রাবণ মাস, না? – আহা, তাই অন্তরে আমার বরিষণের ব্যথাটুকু ঘনিয়ে আসছে! –
সে হল আজ তিন বছরের কথা। আমার এই খাপছাড়া জীবন তার স্মৃতিগুলো ঝড়ের মুখে পদ্মবনের মতো ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে! কখনও তার একটি কথা মনে পড়ে, কখনও তার আধখানি ছোঁয়া আমার দাগা-পাওয়া বুকে জাগে! মানস-বনের জুঁই-কুঁড়ি আমার ফুটতে গিয়ে ফুটতে পায় না, শিউলির বোঁটা শিথিল হয়ে যায়। ওরই সাথে এই শাওন-ঘন দেয়া-গরজনে আর এক দিনের অমনই মেঘের ডাক মনে পড়ে, আর আঁখি আমার আপনি জলে ভরে ওঠে!
সেদিন ছিল আজকার মতোই শ্রাবণের শুক্লা পঞ্চমী। পথহারা আমি ঘুরতে ঘুরতে যেদিন প্রথম এই কালিঞ্জরে এসে পড়ি, সেদিন এখানে কাজরি উৎসবের মহা ধুম পড়ে গেছে – আকাশভরা হালকা জলো মেঘ আমারই মতো খাপছাড়া হয়ে যেন অকূল আকাশে কূল হারিয়ে ফিরছিল। তারই ঈষৎ ফাঁকে সুনীল গগনের এক ফালি নীলিমা যেন কোন্ অনন্ত-কান্নারত প্রেয়সীর কাজল-মাখা কালো চোখের রেখার মতো করুণ হয়ে জাগছিল! পথ-চলার নিবিড় শ্রান্তি নিয়ে কালিঞ্জরের উপকণ্ঠের বাঁকে উপবনের পাশে তার সাথে আমার প্রথম দেখা। এই হঠাৎ দেখাতেই কেন আমার মনে হল, এ-মুখ যে আমার কত কালের চেনা – কোথায় যেন একে হারিয়েছিলাম! সেও আমার পানে চেয়ে আমার চাওয়ায় কী দেখতে পেলে সেই জানে, – তাই পথ চলতে চলতে তার হাতের কচি ধানের ছোট্ট গোছাটি মুখের উপর আধ-আড়াল করে আমায় জিজ্ঞেস করলে, – ‘পরদেশিয়া রে, তুহার দেশ কাহাঁ?’ সে স্বর আমার বাইরে ভিতরে এক ব্যাকুল রোমাঞ্চ দিয়ে গেল, বুকের সমস্ত রক্ত আকুল আবেগে কেঁপে কেঁপে নৃত্য করে উঠল!