উঁহুঁ, – আমি কাজ চাই! নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চাই। এ কী অস্বস্তির আরাম!
আচ্ছা, আগুনে পুড়ে নাকি লোহাও ইস্পাত হয়ে যায়। মানুষ কী হয়? শুধু ‘ব্যাপটাইজড’?
আবার মনটা ছাড়া পেয়ে আমার সেই আঙুর আর বেদানা গাছে ভরা ঘরটার দৌড় মেরেছে! আবার মনে পড়ছে সেই কথা! …
‘হেনা, আমি যাচ্ছি মুক্ত দেশের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে! যার ভিতরে আগুন, আমি চাই তার বাইরেও আগুন জ্বলুক! আর হয়তো আসব না। তবে আমার সম্বল কী? পাথেয় কই? আমি কী নিয়ে সেই অচিন দেশে থাকব?’
আমার হাতের মুঠোয় হেনার হেনারঞ্জিত হাত দুটি কিশলয়ের মতো কেঁপে কেঁপে উঠল। সে স্পষ্টই বললে, – ‘এ তো তোমার জীবনের সার্থকতা নয় সোহরাব! এ তোমার রক্তের উষ্ণতা! এ কী মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরতে যাচ্ছ! এখনও বোঝ! – আমি তোমায় আজও ভালবাসতে পারিনি।’
সব খালি! সব শূন্য! খাঁ – খাঁ – খাঁ! একটা জোর দমকা বাতাস ঘন ঝাউ গাছে বাধা পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, – আঃ – আঃ – আঃ!
যখন কোয়েটা থেকে আমাদের ১২৭ নম্বর বেলুচি রেজিমেন্টের প্রথম ‘ব্যাটেলিয়ন’যাত্রা করলে এই দেশে আসবার জন্যে, তখন আমার বন্ধু একজন যুবক বাঙালি ডাক্তার সেব গাছের তলায় বসে গাচ্ছিল, –
‘এখন ফিরাবে তারে কীসের ছলে,
বিদায় করেছ যারে নয়ন-জলে। –
আজি মধু সমীরণে
নিশীথে কুসুম-বনে,
তারে কি পড়েছে মনে বকুল-তলে,
এখন ফিরাবে হায় কীসের ছলে!
মধুনিশি পূর্ণিমার
ফিরে আসে বার বার
সে জন ফিরে না আর যে গেছে চলে!
এখন ফিরাবে আর কীসের ছলে!’
কী দুর্বল আমি। সাধে কী আসতে চাইনি এখানে! ওগো, এরকম নওয়াবি-জীবন আমার চলবে না!
আমার রেজিমেন্টের লোকগুলো মনে করে আমার মতো এত মুক্ত, এত সুখী আর নেই! কারণ আমি বড্ড বেশি হাসি। হায়, মেহেদি পাতার সবুজ বুকে যে কত ‘খুন’ লুকানো থাকে, কে তার খবর নেয়!
আমি পিয়ানোতে ‘হোম হোম সুইট সুইট হোম’ গতটা বাজিয়ে সুন্দর রূপে গাইলুম দেখে ফরাসিরা অবাক হয়ে গেছে, যেন আমরা মানুষই নই, ওদের মতো কোনো কাজ করা যেন আমাদের পক্ষে এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার! এ ভুল কিন্তু ভাঙাতেই হবে।
হিন্ডেনবার্গ লাইন
কী করি, কাজ না থাকলেও আমায় কাজ খুঁজে নিতে হয়। কাল রাত্তিরে প্রায় দু-মাইল শুধু হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে ওদের অনেক তার কেটে দিয়ে এসেছি। কেউ এতটুকু টের পায়নি।
আমার ‘কমান্ডিং অফিসার’ সাহেব বলেছেন, ‘তুমকো বাহাদুরি মিল যায়েগা।’
আজ আমি ‘হাবিলদার’ হলুম।
এ মন্দ খেলা নয় তো! –
আবার সেই বিদেশিনির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এই দুবছরে কত বেশি সুন্দর হয়ে গেছে সে! সেদিন সে সোজাসুজি বললে যে, (যদি আমার আপত্তি না থাকে) সে আমায় তার সঙ্গী-রূপে পেতে চায়! আমি বললুম, – ‘না, তা হতেই পারে না।’
মনে মনে বললুম, – ‘অন্ধের লাঠি একবার হারায়। আবার? আর না, যা যা খেয়েছি, তাই সামলানো দায়।’
বিদেশিনির নীল চোখ দুটা যে কীরকম জলে ভরে উঠেছিল, আর বুকটা তার কীরকম ফুলে ফুলে উঠেছিল, তা আমার মতো পাষাণকেও কাঁদিয়েছিল!
তারপর সে নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, – ‘তবে আমাকে ভালোবাসতে দেবে তো? অন্তত ভাই-এর মতো …’
আমি বেওয়ারিশ মাল। অতএব খুব আগ্রহ দেখিয়ে বললুম, – ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়!’ তার পর তার ভাষার ‘অডিএ’ (বিদায়) বলে সে যে সেই গিয়েছে, আর আসেনি! আমার শুধু মনে হচ্ছে, – ‘সে জন ফিরে না আর যে গেছে চলে! …’
ওঃ –
যা হোক, আজ গুর্খাদের পেয়ে বেশ থাকা গেছে কিন্তু। গুর্খাগুলো এখনও যেন এক একটা শিশু । দুনিয়ার মানুষ যে এত সরল হতে পারে, তা আমার বিশ্বাসই ছিল না। এই গুর্খা আর তাদের ভায়রা-ভাই ‘গাড়োয়াল’, এই দুটো জাতই আবার যুদ্ধের সময় কীরকম ভীষণ হয়ে ওঠে! তখন প্রত্যেকে যেন এক-একটা ‘শেরে বব্বর’! এদের ‘খুক্রি’ দেখলে এখনও জার্মানরা রাইফেল ছেড়ে পালায়। এই দুটো জাত যদি না থাকত, তাহলে আজ এতদূর এগুতে পারতুম না আমরা। তাদের মাত্র কয় জন আর বেঁচে আছে। রেজিমেন্টকে রেজিমেন্ট একেবারে সাবাড়! অথচ যে দু-চার জন বেঁচে আছে, তারাই কীরকম হাসছে খেলছে! যেন কিছুই হয়নি।
ওরা যে মস্ত একটা কাজ করেছে, এইটেই কেউ এখনও ওদের বুঝিয়ে উঠতে পারেনি! আর ওই অত লম্বা-চওড়া শিখগুলো, তারা কী বিশ্বাসঘাতকতাই না করেছে! নিজের হাতে নিজে গুলি মেরে হাসপাতালে গিয়েছে।
বাহবা! ট্রেঞ্চের ভিতর একটা ব্যাটালিয়ন ‘মার্চ’ হচ্ছে। ফ্রান্সের মধুর ব্যান্ডের তালে তালে কী সুন্দর পা-গুলো পড়ছে আমাদের! লেফট – রাইট – লেফট! ঝপ – ঝপ – ঝপ। এই হাজার লোকের পা এক সঙ্গেই উঠছে, এক সঙ্গেই পড়ছে! কী সুন্দর!
বেলুচিস্তান
কোয়েটার দ্রাক্ষাকুঞ্জস্থিত
আমার ছোট্ট কুটির
এ কী হল? আজ এই আখরোট আর নাশপাতির বাগানে বসে বসে তাই ভাবছি!
আমাদের সব ভারতীয় সৈন্য দেশে ফিরে এল, আমিও এলুম। কিন্তু সে দুটো বছর কী সুখেই কেটেছে!
আজ এই স্বচ্ছ নীল একটু-আগে-বৃষ্টির জলে-ধোয়া আশমানটি দেখছি, আর মনে পড়ছে সেই ফরাসি তরুণীটির ফাঁক ফাঁক নীল চোখ দুটি। পাহাড়ে ওই চমরী মৃগ দেখে তার সেই থোকা থোকা কোঁকড়ান রেশমি চুলগুলো মনে পড়ছে। আর ওই যে পাকা আঙুর ঢল ঢল করছে, অমনি স্বচ্ছ তার চোখের জল।
আমি ‘আফসার’ হয়ে ‘সর্দার বাহাদুর’ খেতাব পেলুম। সাহেব আমায় কিছুতেই ছাড়বে না। – হায়, কে বুঝবে আর কাকেই বা বোঝাব, ওগো আমি বাঁধন কিনতে আসিনি। সিন্ধুপারে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে নিয়েও যাইনি। ও শুধু নিজেকে পুড়িয়ে খাঁটি করে নিতে, – নিজেকে চাপা দিতে! –