- বইয়ের নামঃ ব্যথার দান
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. দারার কথা
গোলেস্তান
গোলেস্তান! অনেক দিন পরে তোমার বুকে ফিরে এসেছি। আঃ মাটির মা আমার, কত ঠান্ডা তোমার কোল! আজ শূন্য আঙিনায় দাঁড়িয়ে প্রথমেই আমার মনে পড়ছে জননীর সেই স্নেহবিজড়িত চুম্বন আর অফুরন্ত অমূলক আশঙ্কা, আমায় নিয়ে তাঁর সেই ক্ষুধিত স্নেহের ব্যাকুল বেদনা,… সেই ঘুম-পাড়ানোর সরল ছড়া, –
ঘুম-পাড়ানি, মাসি-পিসি ঘুম দিয়ে যেয়ো,
বাটা ভরে পান দেব গাল ভরে খেয়ো!
আরও মনে পড়ছে আমাদের মা-ছেলের শত অকারণ আদর-আবদার! সে মা আজ কোথায়?
দু-এক দিন ভাবি, হয়তো মায়ের এই অন্ধ স্নেহটাই আমাকে আমার এই বড়ো-মা দেশটাকে চিনতে দেয়নি। বেহেশ্ত হতে আবদেরে ছেলের কান্না মা শুনতে পাচ্ছেন কিনা জানিনে, কিন্তু এ আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি যে, মাকে হারিয়েছি বলেই – মাতৃ-স্নেহের ওই মস্ত শিকলটা আপনা হতে ছিঁড়ে গিয়েছে বলেই আজ মার চেয়েও মহীয়সী আমার জন্মভূমিকে চিনতে পেরেছি। তবে এও আমাকে স্বীকার করতে হবে, – মাকে আগে আমার প্রাণ-ভরা শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা অন্তরের অন্তর থেকে দিয়েই আজ মার চেয়েও বড়ো জন্মভূমিকে ভালোবাসতে শিখেছি। মাকে আমি ছোটো করচি নে। ধরতে গেলে মা-ই বড়ো। ভালবাসতে শিখিয়েছেন তো মা। আমার প্রাণে স্নেহের সুরধুনী বইয়েছেন তো মা। আমাকে কাজ-অকাজে এমন করে সাড়া দিতে শিখিয়েছেন যে মা! মা পথ দেখিয়েছেন, আর আমি চলেছি সেই পথ ধরে। লোকে ভাবছে, কী খামখেয়ালি পাগল আমি! কী কাঁটা-ভরা ধ্বংসের পথে চলেছি আমি! কিন্তু আমার চলার খবর মা জানতেন, আর সে-কথা শুধু আমি জানি।
আমায় লোকে ঘৃণা করছে? আহা, আমি ওই তো চাই। তবে একটা দিন আসবেই যেদিন লোকে আমার সঠিক খবর জানতে পেরে দু-ফোঁটা সমবেদনার অশ্রু ফেলবেই ফেলবে। কিন্তু আমি হয়তো তা আর দেখতে পাব না। আর তা দেখে অভিমানী স্নেহ-বঞ্চিতের মতো আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আসবে না। সেদিন হয়তো আমি থাকব দুঃখ-কান্নার সুদূর পারে।
চমন
আচ্ছা মা! তুমি তো মরে শান্তি পেয়েছ, কিন্তু এ কী অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে গেলে আমার প্রাণে? আমি চিরদিনই বলেছি, না – না – না, আমি এ পাপের বোঝা বইতে পারব না, কিন্তু তা তুমি শুনলে কই? সেকথা শুধু হেসেই উড়িয়ে দিলে, যেন আমার মনের কথা সব জান আর কী! … এই যে বেদৌরাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেলে, এর জন্যে দায়ী কে? এখন যে আমার সকল কাজেই বাধা! কোথাও পালিয়েও যে টিকতে পারছিনে! … আমি আজ বুঝতে পারছি মা, যে, আমার এই ঘর-ছাড়া উদাস মনটার স্থিতির জন্যেই এই পুষ্প-শিকলটা তোমার চির-বিদায়ের দিনে নিজের হাতে আমায় পরিয়ে গিয়েছ। ওই মালাই তো হয়েছে আমার জ্বালা! লোহার শিকল ছিন্ন করবার ক্ষমতা আমার আছে, কিন্তু ফুলের শিকল দলে যাওয়ার মতো নির্মম শক্তি তো নেই আমার। … যা কঠোর, তার উপর কঠোরতা সহজেই আসে; কিন্তু যা কোমল পেলব নমনীয়, তাকে আঘাত করবে কে? তারই আঘাত যে আর সইতে পারছিনে!
হতভাগিনি বেদৌরা! সে কথা কি মনে পড়ে – সেই মায়ের শেষ দিন? – সেই নিদারুণ দিনটা? – মায়ের শিয়রে মরণের দূত ম্লান মুখে অপেক্ষা করছে – বেদনাপ্লুত তাঁর মুখে একটা নির্বিকার তৃপ্তির আবছায়া ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে, – জীবনের শেষ রুধিরটুকু অশ্রু হয়ে তোমার আর আমার মঙ্গলেচ্ছায় আমাদেরই আনত শিরে চুঁইয়ে পড়ছে। মার পূত সে শেষের অশ্রু বেদনায় যেমন উত্তপ্ত, শান্ত স্নেহভরা আশিসে তেমনই স্নিগ্ধ-শীতল! তোমার অযতনে-থোওয়া কালো কোঁকড়ান কেশের রাশ আমাকে সুদ্ধ ঝেঁপে দিয়েছে, আর তার অনেকগুলো আমাদেরই অশ্রু-জলে সিক্ত হয়ে আমার হাতে-গলায় জড়িয়ে গিয়েছে – আমার হাতের উপর কচি পাতার মতো তোমার কোমল হাত দুটি থুয়ে মা অশ্রু-জড়িত কণ্ঠে আদেশ করছেন, – ‘দারা, প্রতিজ্ঞা কর, বেদৌরাকে কখনো ছাড়বিনে।’
তারপর তাঁর শেষের কথাগুলো আরও জড়িয়ে ভারী হয়ে এল, – ‘এর আর কেউ নেই যে বাপ, এই অনাথা মেয়েটাকে যে আমিই এত আদুরে আর অভিমানী করে ফেলেছি!’
সে কী ব্যথিত-ব্যাকুল আদেশ, গভীর স্নেহের সে কী নিশ্চিত নির্ভরতা!
তারপরে মনে পড়ে বেদৌরা, আমাদের সেই কিশোর মর্মতলে একটু একটু করে ভালোবাসার গভীর দাগ, গাঢ় অরুণিমা। … মুখোমুখি বসে থেকেও হৃদয়ের সেই আকুল কান্না, মনে পড়ে কি সে সব বেদৌরা? তখন আপনি মনে হত, এই পাওয়ার ব্যথাটাই হচ্চে সব চেয়ে অরুন্তুদ! তা না হলে সাঁঝের মৌন আকাশতলে দুজনে যখন গোলেস্তানের আঙুর-বাগিচায় গিয়ে হাসতে হাসতে বসতাম তখন কেন আমাদের মুখের হাসি এক নিমেষে শুকিয়ে গিয়ে দুইটি প্রাণ গভীর পবিত্র নীরবতায় ভরে উঠত? তখনও কেন অবুঝ বেদনায় আমাদের বুক মুহুর্মুহু কেঁপে উঠত? আঁখির পাতায় পাতায় অশ্রু-শীকর ঘনিয়ে আসত? …
আজ সেটা খুব বেশি করেই বুঝতে পেরেছি বেদৌরা। কেননা এই যে জীবনের অনেকগুলো দিন তোমার বিরহে কেটে গেল, তাতে তোমাকে না হারিয়ে আরও বড়ো করে পেয়েছি। তোমায় যে আমি হারিয়েছিলাম সে তোমাকে এত সহজে পেয়েছিলাম বলেই। বিরহের ব্যথায় জানটা যখন ‘পিয়া পিয়া’ বলে ‘ফরিয়াদ’ করে মরে, তখনকার আনন্দটা এত তীব্র যে, তা একমাত্র বিরহীর বুকই বোঝে, তা প্রকাশ করতে আর কেউ কক্ষনো পারবে না। দুনিয়ায় যত রকম আনন্দ আছে, তার মধ্যে এই বিচ্ছেদের ব্যথাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি আনন্দময়।