আজ রাতের শো হবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। চিন্তাগ্রস্তভাবে মানকড়ের ঘরে ঢুকে দেখলুম হুইস্কির গ্লাস হাতে নিয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে সে বসে আছে চুপচাপা কথাটা জিজ্ঞেস করতে অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আই ডোন্ট নো—’
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার সামনে পর পর দেখা যায় শিউশরণ, বুন্দেলকার ও নরেনবাবুকে। একটু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তারা ঢুকে পড়ে ঘরে—পিছনে পিছনে আরো কয়েকজন অর্ধচন্দ্রাকারে মানকড়কে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপা আমি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি, কেননা, এই প্রথম একটি উপলব্ধি আমার শরীরে শীতের অনুভূতির মতো বিশিষ্ট হতে থাকে মূকাভিনয়ের প্রচণ্ডতা যে ভাষার চেয়ে বেশি কার্যকর তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। অস্পষ্ট রঙমাখা মুখগুলির প্রত্যেকটি চোখে একই রকম অভিব্যক্তি, একই অভিব্যক্তি দাঁড়ানোর ও হাত মুঠো করার ভঙ্গিতে মানকড়ের চোখ ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের মুখের ওপর প্রায় মিনিট দশেক এইভাবে কাটানোর পর উঠে দাঁড়ালো মানকড়, হাত জোড় করল এবং বলল, বাবা, মাফ কর দেও। আর এমন হবে না–’
বুন্দেলকারের ইঙ্গিতে লোকগুলি তখনই প্রস্থান করল, একে একে, নিঃশব্দে। প্রস্থানের এই মূক ভঙ্গিতে এক ধরনের বিষণ্ণতা আছে—যা অতর্কিতে শব্দের সৃষ্টি করে, এবং স্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করা যায় বহুদূর আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া অদৃশ্য প্লেনের মতো এক দূরত্ব।
সেদিন রাতে আর শো হয়নি। মানকড় নিজেই বন্ধ করেছিল।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল চব্বিশ পরগণা ভ্রমণের সময়। এই ঘটনাটির খুঁটিনাটি আমার খুব ভালো করেই মনে আছে, কারণ এই ঘটনার পরেই বিক্ষুব্ধ আমি মূকাভিনয়ের দল ছেড়ে চলে আসি।
সেবারও ক্যাম্প পড়েছিল একটি স্কুলে এটিকে বেস বলা হয়—এটিকে কেন্দ্র করে বিশ বাইশ মাইল দূর পর্যন্ত এক-একটি জায়গায় শো অনুষ্ঠিত হয়। স্কুলবাড়ির এক প্রান্তে দু’টি ঘরে থাকি আমি আর মানকড়, আরেক প্রান্তে অন্যান্যরা। অসুস্থতার কারণে সেদিন আমি দু’তিনটি স্টোরি কভার করেই চলে আসি বেসে আমাদের যাতায়াতের জন্যে একটি জীপ ও একটি স্টেশন ওয়াগনের ব্যবস্থা ছিল জীপটি আমাকে পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে যায় শো-এর জায়গায়। অসুবিধা হবার কথা নয়। ইতিমধ্যেই শুনে শুনে বিভিন্ন সিকোয়েন্সের ভাষ্য রপ্ত করে নিয়েছিল মানকড় জানতুম অশুদ্ধ উচ্চারণে হলেও ধারাবিবরণীর কাজ সেদিনের মতো সে নিজেই চালিয়ে নিতে পারবে।
পরবর্তী সময়প্রবাহ বিষয়ে হুঁশ ছিল না কোনো। তবু হঠাৎই, ঘুমের মধ্যে ঘুম ভেঙে উঠে বসি আমি। একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি অনেকক্ষণ ধরে কর্কশ ও থমথমে, শব্দটা অনুসরণ করে ঘর থেকে বেরিয়ে মানকড়ের ঘরের সামনে পৌঁছে যাই। দরজা বন্ধ। বাইরের অবিমিশ্র অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে একটি লোক। কিছুক্ষণের মধ্যেই চেনা গেল তাকে—নরেনবাবু। সম্ভবত দরজায় আঘাত করছিল।
বিষয়টা বোধগম্য হচ্ছিল না কিছুতেই। কী হয়েছে’ জিজ্ঞেস করাতে অস্ফুট উচ্চারণে লোকটি কী বলল বোঝা গেল না, তারপরেই কপাল চাপড়াতে শুরু করল দু’হাতে সেই মুহূর্তের আচ্ছন্নতাই সম্ভবত জ্ঞানশূন্য করে তুলল আমাকে বন্ধ দরজায় আঘাত করতে করতে চেঁচিয়ে উঠলুম, মানকড়, মিস্টার মানকড়–দরজা খুলুন—’
দরজা খুলল একটু পরে। মানকড় নিজেই খুলল। সে কিছু বলবার আগেই লণ্ঠনের আলোয় চোখে পড়ল, তক্তপোশের ওপর কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসছে রাধা। এটা গ্রাম, কলকাতার হোটেল নয়—মানকড়ও সম্ভবত ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে উঠেছিল, নাহলে সে আগের মতোই আত্মবিশ্বাসে তিরস্কার করে উঠত। এই অব্যবস্থার সুযোগে আমরা সবাই ঢুকে পড়েছি ঘরের মধ্যে।
কিন্তু, পরবর্তী ঘটনার জন্যে আমি আদৌ প্রস্তুত ছিলুম না। ঘরের অস্পষ্ট আলোয় লক্ষ করলুম, নরেনবাবুর হাতে ছুরি—মানকড়ের থেকে গজখানেক দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে সে, অদ্ভুত ভঙ্গি শরীরের, সমগ্রভাবে প্রস্তুত মনে হয় এর পরেই সমবেত দর্শকদের হাততালিতে মুখর হয়ে উঠবে পরিবেশ আতঙ্কজনক অবস্থা কী করব বুঝতে না পেরে স্তম্ভিতভাবে দাঁড়িয়ে থাকলুম আমি।
মানকড় বা রাধার সম্পর্কে এখানে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমি লক্ষ করছি নরেনবাবুকে। মূকাভিনেতার শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি তার চোখে—খুন করার আগেই সে পরিপূর্ণভাবে খুনীকে গ্রহণ করে নিতে পারে চোখে অভিব্যক্তিই এখানে চূড়ান্ত হয়ে ওঠো খুন করার পর অনুতপ্ত খুনী যা যা করে, নরেনবাবুর সেই মুহূর্তের আচরণে সেইসব ধারাবাহিকতায় ত্রুটি ঘটল না কোনো। ছুরিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে কপালের ঘাম মোছার ভঙ্গি করল, চলে গেল দূরত্বে—তারপরেই চকিতে পিছনে ফিরে রাজহাঁসের ডানা ঝাড়ার মতো লম্ববান দুটি হাত কাঁপতে কাঁপাতে ঘুরতে লাগল আমাদের চারদিকে
এতোক্ষণে চেঁচিয়ে উঠল মানকড়, নরেনবাবু!’ সেই চিৎকার সফল মূকাভিনেতার একাগ্রতায় বাধা পড়ল না কোনো। মেঝেয় হাঁটু মুড়ে বসে সে তখন মৃতের জন্যে শোক করতে ব্যস্ত।
আমার হুশ হলো পরে, যখন প্রায় আর্তনাদ করে চেঁচিয়ে উঠল রাধা, ‘পাগল—ও পাগল হয়ে গেছে—’ বলেছি তো, সেদিন আমি ফিরে আসি।