মূকাভিনয়ের পাত্র-পাত্রীদের চরিত্র অবলোকন করতে গিয়ে এরকম আরো অনেক ঘটনাই আমি প্রত্যক্ষ করি এ-রকম একটি খণ্ড রচনায় তার সব বিবরণ পেশ করা সম্ভব নয়। তবে দু’একটা ঘটনা হয়তো এখানেও উল্লেখের দাবী রাখে।
প্রথমটি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অনশন ধর্মঘট।
ঘটনাটি ঘটেছিল ফুলবেড়িয়া গ্রামে। এই গ্রামটিকে কেন্দ্র করে আশপাশের চার-পাঁচটি অঞ্চলে সে সময় আমরা শো করে বেড়াচ্ছি। জায়গাটার একটা সুবিধে ছিল গ্রাম-গাঁ হলেও এখানে বিদ্যুতের অভাব নেই কোনো এবং রাস্তাঘাটও মোটামুটি ভালো। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের একটি অর্ধসমাপ্ত পাকা বাড়িতে ক্যাম্প পড়ল আমাদের নিজে আলাদা থাকার সুবাদে মানকড় আমার জন্যেও একটু আলাদা ব্যবস্থা করেছিল। আলাদা মানে ঐ আর কি—মেঝের বদলে তক্তপোেশ, কাঁচের গ্লাসে জল, ইত্যাদি। তিনবেলা খাবার আসে কাছাকাছি এক গ্রাম্য রেস্তোরাঁ থেকে।
কেষ্ট নামে একটি ছেলে ছিল আমাদের দলে, বাংলা ও হিন্দি দু’ভাষাতেই কথা বলতে পারত এবং প্রায়ই মিশিয়ে এলাহাবাদের ছেলে। অভিজ্ঞতা বলে, দলের মধ্যে সেই যা একটু সবাক ছিল। বিপত্তি ঘটল তাকে নিয়েই।
জায়গার নাম বাণী। হ্যাজাক জ্বালিয়ে শো হবে। এই ধরনের অনুষ্ঠান জমানোর জন্যে যা করণীয় সকাল থেকেই বেরুতে হয় চোঙা নিয়ে ঘোষণায়, হাতে লেখা পোস্টারে লেই লাগিয়ে টাঙাতে হয় থানা, বাজার, বি-ডি-ও অফিস ও পোস্টাপিসের দেয়ালে। এ কাজগুলো কেষ্টই করত। অভিনয়ের জায়গায় পৌঁছে সমস্ত ব্যাপারটা একবার সরেজমিনে তদন্ত করে নিত। মানকড়া
সেদিন শো শুরু হবার সময় পেরিয়ে যেতেও লোকজন না আসায় রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে পড়ল মানকড়া অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মেকআপ নিয়ে তৈরি, পোর্টেবল মাইক্রোফোন সাজিয়ে আমিও তৈরি—এরকম হতাশা থেকে মাঝে মাঝে ‘হ্যালো’ ‘হ্যালো’ করে যাচ্ছি। তাতে দু’চারজন আগাছা কিশোর সমবেত হলেও কাজের কাজ কিছু হলো না। বলতে ভুলে গেছি, এ-ধরনের প্রচার কার্যের সাফল্যের প্রমাণ গ্রাম-প্রধানের সীলসহ সার্টিফিকেটা খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি কাছেই থাকেন। তাঁর কাছে খোঁজখবর করতেই জানা গেল শো-এর ব্যাপারে কেউ কিছু জানে না, এমন কি তাঁর কাছেও কেউ আসেনি। একটুক্ষণ বিব্রত থেকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে মানকড় তাঁকে কী বোঝালো কে জানে, দেখলুম খড়ম পায়ে তিনি গুটি গুটি চলেছেন শো-এর জায়গায়। তাঁর পিছনে পিছনে ক্রমশ জড়ো হতে লাগল আরো কিছু লোক। তখন নিজেই মাইক্রোফোন। তুলে নিয়ে পরিত্রাহি গলায় চ্যাঁচাতে লাগল মানকড়, ‘ভাইসব, বোনসব—এ গ্রামের বিলকুল মেয়েপুরুষ সব লোকজন—চলে আসুন, দলে দলে আসুন দেখুন কেমন মজা হয়, যাত্রা হয়, নাটক হয় দেখুন বোবা মেয়েছেলে, পুরুষ ছেলে কেমন লাফালাফি, কাঁদাকাঁদি করে— ইত্যাদি। উৎসাহী ছেলে-ছোকরাও কিছু জুটে গেল দলে। মেয়ে-পুরুষের মোটামুটি ভিড় জমতে শো শুরু হলো, কেষ্টর দেখা নেই তখনো। দুটো স্টোরির মাঝখানে অল্প বিরতিতে থমথমে মুখে মানকড় বলল, বানচোত যাবে কোথায়! ওর লাশ ফিরত যাবে এলাহাবাদে!’
বস্তুত ঘটলও তাই। সেদিন শো-এর পর ক্যাম্পে ফিরে পাওয়া গেল কেষ্টকে। নেশা ক’রে চুর জানা গেল স্টেশনের কাছাকাছি কোথাও গড়াগড়ি যাচ্ছিল রাস্তায়। পোস্টারের বান্ডিল সমেত একজন তুলে দিয়ে গেছে ক্যাম্পে।
মানকড় সম্ভবত এইরকম একটি দৃষ্টান্তের অপেক্ষাতেই ছিল। কেষ্টকে দেখার পর যে রূপে ও ভূমিকায় সে নিজেকে আবির্ভূত করল তা নিশ্চিত কোনো মানুষের নয়। আরো আশ্চর্য, মূকাভিনয়ের পাত্র-পাত্রীরাও ক্রমাগত দেখিয়ে গেল প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে তাদের অদ্ভুত সংযম— চাবুকের আঘাতে একটি নেশাগ্রস্ত যুবকের চামড়া ফুটে রক্ত বেরুনোর মতো বিস্ময়কর দৃশ্য যেন আর হতেই পারে না।
মানকড় চলে যাবার পর আমি একটু একা হলুম। একা, কেননা মূকাভিনেতা নই। বাড়ির সামনে একটিতে পড়ে আছে ক্ষতবিক্ষত মানুষ, মৃত নয় বোঝা যায় মাঝে মাঝে তার এপাশ ওপাশ মাথা নাড়া দেখো তবে অর্ধমৃত নিশ্চয়ই। দেখলুম, একে একে তার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে অন্যরা, মূক। লোকটিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো ঘরে। গলার স্বর শুনে বোঝা গেল না কে ফাস্ট-এড বক্সের খোঁজ করছে। দীর্ঘ সময় পরে পরে কথা বলার ফলে এদের কণ্ঠস্বরের প্রাথমিকতা কখনোই জড়তামুক্ত হয় না এবং প্রায়ই উচ্চারিত হয় স্তব্ধতা মিশিয়ে
পরের দিন সকালে জানা গেল পুরো দলটিই ধর্মঘট শুরু করেছে। রাতে পরিবেশিত খাদ্য পড়ে রয়েছে যেমন কে তেমন, ছোঁয়নি কেউ। ঘরে ও বারান্দায় কাছাকাছি দূরত্ব রেখে বসে আছে কয়েকটি মেয়ে ও পুরুষ, চোখেমুখে ও বসার ভঙ্গিতে সুস্পষ্ট ক্লান্তি, গত সন্ধ্যার রঙ মুছে না। ফেলায় মুখগুলি আরো কিম্ভুত লাগে। যাকে নিয়ে এতো কাণ্ড, সেই কেষ্টকে সম্ভবত আগলে রেখেছে কোথাও।
আমি তৃতীয় পক্ষ, স্বভাবতই দূরে দূরে থাকছি। দায় মানকড়ের, ব্যাপারটার গুরুত্ব আঁচ করেই সম্ভবত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সে বেলার দিকে একটা বোঝাপড়ার জন্যে নরেনবাবু ও বুন্দেলকারকে ডেকে পাঠিয়েছিল ঘরে, সেই সময় তাদের মধ্যে চাপা গলায় কিছু কথাবার্তা হয়, কিন্তু কাজের কাজ হয় না কিছুই প্রমাণ, অনশনকারীরা স্থান পরিবর্তন করেনি—গত রাতের পর সকালে যাকে যেখানে দেখা গিয়েছিল পরেও দেখা যাচ্ছে সেখানে চা জলখাবার ছোঁয়নি, খাবার ছোঁয়নি। এখানে মাছির রাজত্ব। এইভাবে দুপুর গড়িয়ে গেল।