যা বলছিলুম, মূকাভিনয়ের দলটির সঙ্গে গ্রামে-গ্রামে ‘আল-প্রোটিন’-এর প্রচার চালানোর কাজে বেরিয়ে পড়ার আগে দিন পাঁচ-ছয় নাট্যরূপ রচনার কাজেই ব্যস্ত থাকতে হলে আমাকে। নাট্যরূপ, ভাষ্য ও কিছু কিছু নেপথ্য সংলাপ। এ সবের জন্যে দৈনিক এক নাগাড়ে তিন-চার ঘণ্টা আমাকে কাটাতে হতো মানকড়ের সঙ্গে, তার হোটেলে সেখান থেকে রিহার্সালের জন্যে যেতে হতো ভবানীপুরের সেই পুরনো স্কুলবাড়ির ছাদে ইতিমধ্যে দলটির সঙ্গে প্রায় পরিচিত হয়ে গেছি। নরেনবাবু, রাধা, দুলি, কেষ্ট, শিউশরণ, রাজিন্দর পাঁড়ে, বুন্দেলকার, পদ্মা, যুগল— পরিচিত হয়ে গেছি এইসব নামের সঙ্গে। ভারী অদ্ভুত এই পরিচয়—যেখানে দূরত্ব থেকেই গড়ে ওঠে সম্পর্ক, অধিকাংশ বিনিময়ই চলে নৈঃশব্দ্যের মধ্যে দু’একদিন যাবার পরই এদের ধরন ধারণ আচরণ হাঁফিয়ে তুলছিল আমাকে, ঠিক বুঝতে পারছিলুম না এর কারণ কি! মানকড়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতাই কি এই মানুষগুলিকে আমার প্রতি ইঙ্গিতময় করে রাখে! এটা ঠিক, চঞ্চল হবার আগেই মানকড়ের এদের প্রচি আচরণ ক্ষমতাবান প্রভুর মতো একপেশে ও কঠোর কিছু বা বক্রও এটা একটা কারণ হতে পারে, নাও হতে পারে। বস্তুত, ইতিমধ্যে একধরনের ভয়ও আমাকে গ্রাস করতে শুরু করেছিল। লক্ষ করছিলুম, ইদানীং আমি নিজেও কথা বলছি কম, কিংবা বলছি ঠিক ততোটুকুই, যতোটা না বললেই নয়। লক্ষ করছিলুম, জিব ও ঠোঁট চঞ্চল হবার আগেই চঞ্চল হয়ে ওঠে আমার অন্যান্য অবয়ব প্রায় জোর করেই এইসব সময় নাড়া দিতুম নিজেকে, যাতে ফিরে পাই ব্যক্তিত্ব।
সম্ভবত আমরা একটা গল্পের মধ্যে চলে যাচ্ছি। কিন্তু আগেই বলেছি, এটা গল্প নয়। তবে ইচ্ছে করলে এই সব ছোটোখাটো অভিজ্ঞতা ও ঘটনা থেকেই যে গল্পের আবহ তৈরি করা যায় না, তা নয়। কমবেশি—তখনই মনে হয়েছিল আমার—এরা সকলেই এক-একটি চরিত্র এবং যতোই ক্ষুদ্র হোক, এদের প্রত্যেকেরই ইঙ্গিত-ভারাক্রান্ত দিনযাপনের আড়ালে কোনো-না-কোনো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বিশেষত মানকড়—সে নিজেই একটি চরিত্র। একটি ঘটনার উল্লেখ করা এখানে বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। মূকাভিনয়ের দলটির গতিবিধি সম্পর্কে আমাকে একেবারে অস্পষ্ট রাখা হলেও কাজের সময় ছাড়াও কোনো-না-কোনো ভাবে মানকড় যে এদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল না কোনো। কলকাতায় থাকতে থাকতেই একদিন এই সূত্রে আমি একটি বিরল ঘটনা প্রত্যক্ষ করি।
মানকড় সাধারণত সময় মেনে চলতে অভ্যস্ত। প্রতিদিনই ফেরার আগে সে আমাকে জিজ্ঞেস করে নিত পরের দিন ঠিক কোন সময়ে আমি আসবা যতোদূর সম্ভব আমি এই সময় মেনে চলতুম। যেদিনের কথা বলছি সেদিন নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় আধঘণ্টা আগেই আমি হোটেলে পৌঁছুই নির্দিষ্ট কোনো কাজের অভাবে মানকড়ের ঘরের দরজায় ‘ডু নট ডিসটার্ব’-এর নোটিস ঝোলানো ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়েই সহজ বাঙালিপনায় অভ্যস্ত আমি কলিং বেল টিপি, কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করি, কোনো সাড়াশব্দ মেলে না। হয়তো অবেলায় ঘুমুচ্ছে এ রকম একটা ধারণা থেকে পুনরায় কলিং বেল ব্যবহার করার কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা খোলে এবং অল্প-ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় মানকড়ের বিরক্ত মুখ—
‘হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? নোটিস দ্যাখেননি?’
‘একটু আগেই এসে পড়েছি–’, বিব্রত গলায় বলি আমি
মানকড়ের বিরক্ত মুখের পরিবর্তন হয় না। সোজাসুজি তাকিয়ে পরিষ্কার গলায় বলল, ‘তাহলে অপেক্ষা করুন লবিতে ঠিক সময়ে আমি ডাকব আপনাকে।’
সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় দরজা এবং সশব্দে। শব্দই বুঝিয়ে দেয় ঘটনাটি কতো অপমানজনক। লবির দিকে যেতে যেতে একটা প্রতিক্রিয়া শুরু হয় আমার মধ্যে, ভাবি, ফিরে যাওয়াই সঙ্গত। তবু কোনোরকমে নিরস্ত করি নিজেকে, নানা কথা বুঝিয়ে। আসলে আমার প্রয়োজনই আমাকে নিরস্ত করতে থাকে। একটা সিগারেট ধরিয়ে বিষণ্ণ আমি লবিতে ঘোরাফেরা করতে করতেই দেখতে পাই রাজিন্দরকে—মাইম’ গ্রপের এই যুবকটির উল্লেখ সম্ভবত আগেই করেছি। উত্তরপ্রদেশের এই যুবকটি ও তার বোন পদ্মা অনেকদিন কাজ করছে। মানকড়ের সঙ্গে শুনেছিলুম পদ্মা বিধবা এবং রাজিন্দরও সম্পূর্ণ অশিক্ষিত—যদিও মূকাভিনয়ে তাদের অভিজ্ঞতা অনেকদিনের। সে যাই হোক, চোখাচোখি হতেই সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারণে রাজিন্দর আমাকে এড়িয়ে যেতে তৎপর হয়ে ওঠো অভিনয়ের সময়েই শুধু নয়, রাজিন্দরের স্বাভাবিক পদক্ষেপেও একটা পা টিপে চলার ভঙ্গি আছে। সম্ভবত ব্যক্তিগত জীবন থেকেও এরা। শব্দকে বাদ দিতে চায়।
অপেক্ষা ক্লান্ত করে তুলছিল। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের চার-পাঁচ মিনিট আগেই ফিরে যাই মানকড়ের ঘরের কাছে, অদূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। আর তখনই চোখে পড়ে ঘটনাটা দেখি, মানকড়ের ঘর থেকে এস্ত পায়ে বেরিয়ে আসছে পদ্মা এবং তার পিছনে একটি রোমশ হাত দরজায় ঝোলানো ডু নট ডিসটার্বের নোটিসটা তুলে নিচ্ছে। আমাকে দেখেই করিডোরের মধ্যে থমকে দাঁড়ায় পদ্মা কাঁধ থেকে হাত দুটো চল্লিশ ডিগ্রি রেখায় ছড়িয়ে পড়ে দু’ পাশে, শক্ত হয়ে ওঠে মুঠো এবং বিস্ফারিত হয়ে ওঠে চোখ দুটি সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় আমার স্টোরি নাম্বার সেভেন, সিকোয়েন্স থ্রিা বস্তুত, এই দৃশ্যে পদ্মা হাততালি পাবার মতোই অভিনয় করে।