বিষয়টি কৌতূহল সৃষ্টি করছিল আমার মধ্যে পারিশ্রমিকের অঙ্কও মন্দ নয়। সে তুলনায়, বলা উচিত, কাজ কমই। মোটামুটি রাজী হয়ে গেলাম। মানকড় আমাকে অভিনয়ের বিষয়গুলি বুঝিয়ে দিল।
পরের দিন সে আমাকে নিয়ে গেল মহড়া দেখাতে।
এটাকে গল্পের ভূমিকা হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু আমার নিজেরই সন্দেহ আছে এটা গল্প কি না। বস্তুত গল্পের পরিকল্পনা নিয়ে এই রচনার কথা ভাবা হয়নি আমার লক্ষ্য মূকাভিনয়ের সূত্রে পাত্র-পাত্রীদের কিছু চরিত্র অবলোকনা এই করতে গিয়ে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে তা হলো, মূকাভিনেতারা সাধারণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থেকে রীতিমতো আলাদা।
মানকড় নিজে এক অভিজাত হোটেলে উঠলেও তার দল উঠেছে ভবানীপুর অঞ্চলে একটি পুরনো বাড়িতে অনেক গলিঘুজি পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে বাড়িটি চারতলা। নিচে স্কুল, আশপাশে ঘন জনবসতি তিনতলা সিঁড়ি ভেঙে উঠে চারতলাটি বিরাট হলঘর আকারের হতে পারে কখনো-সখনো বিয়ের জন্যেও ভাড়া দেওয়া হয়। সময়টা বিকেল, ছুটি হয়ে গেছে স্কুল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তাই একটা গা-ছমছম-করা স্তব্ধতা ঘিরে ধরে আমাদের প্রায় পোড়ো বাড়ির শূন্যতায় ছড়িয়ে আছে পায়রার বিষ্ঠার গন্ধ সিঁড়িময় ধুলো, আমাদের পদশব্দে লুকানো ঘুলঘুলি থেকে জানলা দিয়ে উড়ে যায় কয়েকটি পায়রা।
এটা মূকাভিনয়ের পটভূমি তৈরির চেষ্টা নয়া আসল ব্যাপারটি আসে পরে।
ছাদের ঘরটি বেশ বড়ো ধুলো ও আসবাবহীনতায় আরো বড় দেখায়। গোটা দু’তিন নড়বড়ে চেয়ার অবশ্য ছিল ঘরে ঢুকেই চোখে পড়ল একটা বিজাতীয় রূপ মুখে রঙমাখা জন চার-পাঁচ পুরুষ ও নারী—তাদের কেউ উবু হয়ে বসে আছে ধুলোয়, কেউ চেয়ারে আমাকে সহ মানকড়কে ঢুকতে দেখে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল লোকগুলি—আচরণে তৎপরতা বা অভ্যর্থনা প্রকাশ পেল না কোনো। বরং যেভাবে উঠে দাঁড়াল এবং বিভিন্ন স্থান থেকে একত্র হয়ে এলো, তাতেই হঠাৎই অন্য একটা ভাবনা এসে যেতে পারে মনে—দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কয়েকজন অপরাধী ঘাতকের আবির্ভাবে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল।
কোনো আনুষ্ঠানিক পরিচয় দানের প্রয়োজন বোধ করল না মানকড়া ঘরে ঢোকার থেকে পরবর্তী কাজের মধ্যে ব্যবধান ছিল একটি সিগারেট ধরানোর, তারপরেই একটি স্বতঃস্ফুর্ত যান্ত্রিকতায় অভ্যস্ত তার বাচনভঙ্গি শোনা গেল, ‘স্টোরি নাম্বার থ্রিা অ্যাকশন—’
ঘটনাটি দেখবার মতো নির্দিষ্ট জায়গা থেকে প্রায় চারফুট দূরত্বে লাফিয়ে এলো কুশীলবদের একজন বলাই বাহুল্য, পুরুষ, সেই লাফের বিশিষ্টতা অর্জন কোনো মহিলার পক্ষে সম্ভব নয়। মঞ্চের অভাবে ধুলোমাখা মেঝেই তখন মঞ্চ। লোকটি তার হাত, পা, সমগ্র শরীর ও বিশেষত চোখের ভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তুলছে অমানুষিক রূপ। মানকড় আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, ‘লোকটি বাড়ি ফিরছে সারাদিন লেবারের পর। কিন্তু অপুষ্টিতে হাঁটতে পারছে না—
মানকড়ের সূত্র থেকে কাহিনীক্রম তখন এগিয়ে গেছে আরো অনেক দূর—ঠিক সেই সময়ে ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবতীটি এগিয়ে এসেছে লোকটির শুশ্রষায়, বোঝা গেল স্ত্রী মূর্ত তার অভিনয়ে যন্ত্রণার চেয়ে বেশি স্পষ্ট অসহায়তা—এবার সে একটি হঠাৎ-মৃত্যু প্রত্যক্ষ করবে প্রতিবেশীরাও সমবেতা প্রায় মিনিট দশেক এইভাবে চলার পর মৃত প্রথম অভিনেতাটিকে অন্যান্য প্রতিবেশীরা কাঁধে তুলে নিয়ে যাবার সময় মানকড় হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠল, ‘বল, হরি…হরি বল…’। মূকাভিনেত্রীর মুদ্রায় বিভ্রম ঘটল না কোনো, ধূসর মেঝেয় সে তখনো মাথা ঠুকে চলেছে ক্রমাগত।
নরেনবাবু, আপনি যে লাফটা দিলেন তা হয়েছে হনুমানের মতো—’অভিনেতা-অভিনেত্রীরা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবার পর মানকড় বলল, ‘শালা মরবার আগে যদি এইসে লাফ দিবেন তো মালনিউট্রিসনের ফিকির কি।’ যাকে বলা হলো সেই প্রথম অভিনেতা নরেনবাবুর চোখে কিছু বা অস্বস্তি ফুটে উঠল, আর কিছু নয়। অন্যরাও কথায় ফিরল না। মানকড় তখনো অন্যান্যদের খুঁটিনাটি উদ্ধার করছে। মেয়েটির নাম রাধা। হঠাৎই প্রত্যক্ষ করলুম, মূকাভিনয়ের এইসব পাত্র পাত্রীরা অভিনয়ের বাইরেও প্রায় স্তব্ধতায় বিশ্বাস করে। এতোটা সময়ের মধ্যে আমি একটিই অত্যন্ত মৃদু উচ্চারণ শুনলুম, মেয়েটির গলায়, ‘আমার চিরুনিটা কোথায়?
‘এক একটা শোয়ে এমন দশ থেকে বারো স্টোরি প্রেজেন্ট করা হয়—’ ফেরার পথে মানকড় আমাকে বোঝাতে শুরু করল, প্রত্যেক স্টোরিতেই একটা লেসেন আছে, দ্যাটিজ, আল-প্রোটিন হেলথ ভালো রাখার পক্ষে খুব জরুরি। তবে হ্যাঁ, রিভিসন দরকার—আই উড শো ইউ দ্য স্ক্রিপ্টস ডেথটা হাইলি মেলোড্রামাটিক—কী মনে করেন? পাবলিসিটি অ্যাসপেক্টটাও দেখতে হবে তো।’
আমি সায় দিলুম। পরের দিন থেকেই লেগে যেতে হলো স্ক্রিপ্ট তৈরির কাজে। আর দিন পাঁচ সাতের মধ্যেই বেরুতে হবে আমাদের।
মূকাভিনয়ের তাৎপর্য ও ধরন-ধারণ বিষয়ে ইতিমধ্যেই হয়তো কিছু ধারণা করা যাচ্ছে। এটা অভিনয়ের একটা ধরন মাত্র কিন্তু আমি ঠিক বলতে পারব না, মূকাভিনয়ের পাত্র-পাত্রীদের সঙ্গে অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের অভিনয়ের পাত্র-পাত্রীদের প্রভেদ ঠিক কোনখানে শুরু হয়। কিংবা, এ কথাও বলা খুব কঠিন, অভিনয় প্রত্যক্ষভাবে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আনে কি না। সাধারণত আনে না। কিন্তু খুব নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি আমি, মানকড়ের দলের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চরিত্রে ও আচরণে সেই সময়েই আমি কিছু কিছু বৈচিত্র্য লক্ষ করেছিলুম-সাধারণ মানুষের চরিত্রোচিত ব্যবহার ও আচরণের সঙ্গে প্রায়ই যার পার্থক্য ঘটে যায়। প্রথমত, অভিনয়ের ক্ষেত্র ছাড়াও এঁরা কথা বলেন খুব কম এবং প্রায়ই বলেন না। আর যেটুকু বলেন সবই ভঙ্গির মাধ্যমে দ্বিতীয়ত, এঁরা নিঃসঙ্গ থাকতে ভালোবাসেনা এই দ্বিতীয় ব্যাপারটিই পরবর্তী কয়েক দিনে বিশেষভাবে চোখে পড়ে। এমন কি মাইম’ দলের সদস্যদের দু’জন, নরেনবাবু ও রাধা—স্বামী-স্ত্রী, যেটা পরে শুনেছিলুম মানকড়েরই মুখে—স্বামী-স্ত্রী হয়েও পরস্পরের মধ্যে রেখে চলেন এক অস্বাভাবিক দূরত্ব, যেটা যে-কোনো সাধারণ বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনেই বিভ্রম সৃষ্টি করতে পারে।