২
রাণী দেখিল,
কি! আপন পেটের পুত্র,
সে-ই হইল শত্রু!-
রাণীর মনের আগুণ জ্বলিয়া উঠিল।
এক রাত্রে রাজার হাতীশালে হাতী মরিল, ঘোড়াশালে ঘোড়া মরিল, গোহালে গরু মরিল;-রাজা ফাঁপরে পড়িলেন।
পর রাত্রে ঘরে “কাঁই মাঁই!!” চমকিয়া রাজা তলোয়ার নিয়া উঠিলেন।-সোনার খাটে অজিত-কুসুম ঘুমায়; এক মস্ত রাক্ষস কুসুমকে ধরিয়া আনিল। রাক্ষসের হাতে কুসুম কাঠির পুতুল! ছুটিয়া আসিয়া মাথার চুল ছিঁড়িয়া রাজার গায়ে মারিল,-হাত নড়ে না, পা নড়ে না, রাজা বোকা হইয়া গেলেন।
রাজার চোখের সামনে রাক্ষস কুসুমকে খাইতে লাগিল। রাজা চোখের জলে ভাসিয়া গেলেন, মুছিতে পারিলেন না। রাজার শরীর থরথর কাঁপে, রাজা বসিতে পারিলেন না। রাণী খিল্খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল।
অজিতের ঘুম ভাঙ্গিল;-
রাত যেন নিশে
মন যেন বিষে,
দাদা কাছে নাই কেন?
অজিত ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দেখে, ঘর ছম্ছম্ করিতেছে, রাণীর হাতে বালা-কাঁকণ ঝম্ঝম্ করিতেছে,-দাদাকে রাক্ষসে খাইতেছে! গায়ের রোমে কাঁটা, চোখের পলক ভাঁটা, অজিত ছুটিয়া গিয়া রাক্ষসের মাথায় এক চড় মারিল। রাস “আঁই আঁই’ করিয়া ঘুরিয়া পড়িয়া এক সোনার ডেলা উগরিয়া পলাইয়া গেল!
রাণী দেখিল, পৃথিবী উল্টিয়াছে-পেটের ছেলে শত্রু হইয়াছে! রাণী মনের আগুনে জ্ঞান-দিশা হারাইয়া আপনার ছেলেকে মুড়মুড় করিয়া চিবাইয়া খাইল! রাণীর গলা দিয়া এক লোহার ডেলা গড়াইয়া পড়িল।
রাণীর পা উছল, রাণীর চোখ উখর, সোনার ডেলা লোহার ডেলা নিয়া রাণী ছাদে উঠিল।
ছাদে রাক্ষসের হাট। একদিকে বলে-
হুঁম্ হুঁম্ থাম্ -আঁরো খাঁবো।
আর এক দিকে বলে,-
গুম্ গুম্ গাঁম্-দেঁশে যাঁবো।
রাণী বলিল-
“গব্ গব্ গুম্ থম্ থম্ খাঃ!
আমি হেঁথা থাকি, তোঁরা দেশে যায়ঃ!”
রাজপুরীর চূড়া ভাঙ্গিয়া পড়িল, রাজার বুক কাঁপিয়া উঠিল;-গাছ-পাথর মুচ্ড়িয়া, নদীর জল উছ্লিয়া রাক্ষসের ঝাঁক দেশে ছুটিল।
ঘরে গিয়া রাণীর গা জ্বলে, পা জ্বলে; রাণী সোয়াস্তি পায় না। বাহিরে গিয়া রাণীর মন ছন্ছন্, বুক কন্কন্; রাত আর পোহায় না।
না পারিয়া রাণী আরাম-কাঠি জিরাম-কাঠিটি বাহির করিয়া পোড়াইয়া ফেলিল। তাহার পর, মায়া-মেঘে উঠিয়া, নদীর ধারে এক বাঁশ-বনের তলে সোনার ডেলা, লোহার ডেলা পুঁতিয়া রাখিয়া, রাক্ষসী-রাণী, নিশ্চিত হইয়া ফিরিয়া আসিল।
বাঁশের আগে যে কাক ডাকিল, ঝোপের আড়ে যে শিয়াল কাঁদিল, রাণী তাহা শুনিতে পাইল না।
৩
পরদিন রাজ্যে হুলুস্থুল। ঘরে ঘরে মানুষের হাড়, পথে পথে হাড়ের জাঙ্গাল! রাক্ষসে দেশ ছাইয়া গিয়াছে, আর রক্ষা নাই। যখন সকলে শুনিল, রাজপুত্রদেরও খাইয়াছে, তখন জীবন্ত মানুষ দলে-দলে রাজ্য ছাড়িয়া পলাইয়া গেল।
রাজা বোকা হইয়া রহিলেন; রাজার রাজত্ব রাক্ষসে ছাইয়া গেল।
৪
নদীর ধারে বাঁশের বন হাওয়ায় খেলে, বাতাসে দোলে। এক কৃষাণ সেই বনের বাঁশ কাটিল। বাঁশ চিবিয়া দেখে, দুই বাঁশের মধ্যে বড় বড় গোল দুই ডিম। সাপের ডিম, না কিসের ডিম। কৃষাণ ডিম ফেলিয়া দিল।
অমনি, ডিম ভাঙ্গিয়া, লাল নীল ডিম হইতে লাল নীল রাজপুত্র বাহির হইয়া,-মুকুট মাথে খোলা তরোয়াল হাতে জোড়া রাজপুত্র শন্ শন্ করিয়া রাজ্য ছাড়িয়া চলিয়া গেল!
ডরে কৃষাণ মূর্ছা গেল।
যখন উঠিল, কৃষাণ দেখে, লাল ডিমের খোলস সোনার আর নীল ডিমের খোলস লোহা হইয়া পড়িয়া আছে! তখন লোহা দিয়া কৃষাণ কাস্তে গড়াইল; সোনা দিয়া ছেলের বউর পঁইচে, বাজু বানাইয়া দিল।
চলিয়া চলিয়া, জোড়া রাজপুত্র এক রাজার রাজ্যে আসিলেন। সে রাজ্যে বড় খোক্কসের ভয়। রাজা রোজ মন্ত্রী রাখেন, খোক্কসেরা সে মন্ত্রী খাইয়া যায় আর এক ঘর প্রজা খায়। রাজা নিয়ম করিয়াছেন, যে কোন জোড়া রাজপুত্র খোক্কস মারিতে পারিবে, জোড়া পরীর মত জোড়া রাজকন্যা আর তাঁহার রাজত্ব তাহারাই পাইবে। কত জোড়া রাজপুত্র আসিয়া খোক্কসের পেটে গেল। কেহই খোক্কস মারিতে পারে না; রাজকন্যাও পায় নাই, রাজ্যও পায় নাই।
লালকমল নীলকমল জোড়া রাজপুত্র রাজার কাছে গিয়া বলিলেন,-“আমরা খোক্কস মারিতে আসিয়াছি!”
রাজার মনে একবার আশা নিরাশা; শেষে বলিলেন,-“আচ্ছা।”
নীলকমল লালকমল এক কুঠুরিতে গিয়া, তরোয়াল খুলিয়া বসিয়া রহিলেন।
৫
রাত্রি ক’দন্ড হইল, কেহ আসিল না।
রাত্রি আর ক’দন্ড গেল, কেহ আসিল না।
রাত্রি একপ্রহর হইল, তবু কেহ আসিল না।
শেষে, রাত্রি দুপুর হইল; কেহ আর আসে না। দুই ভাইয়ের বড় ঘম পাইল। নীল লালকে বলিলেন,-“দাদা! আমি ঘুমাই, পরে আমাকে জাগাইয়া তুমি ঘুমাইও।” বলিয়া, বলিলেন,-“খোক্কসে যদি নাম জিজ্ঞাসা করে তো, আমার নাম আগে বলিও, তোমার নাম যেন আগে বলিও না।” লালকমল তরোয়ালে ভর দিয়া সজাগ হইয়া বসিলেন।
খোক্কসেরা আসিয়াই,-আলোতে ভাল দেখিতে পায় না কি-না?-বলিল,-“আলোঁ নিঁবোঁ।”
লালকমল বলিলেন,-“না!”
সকলের বড় খোক্কস রাগে গঁর গঁর,-বলিল-“বঁটে! ঘরে কেঁ জাঁগেঁ?” যত খোক্কসে কিচিমিচি,-“কেঁ জাঁগেঁ, কেঁ জাঁগেঁ?”
লালকমল উত্তর করিলেন-
“নীলকমল জাগে, লালকমল জাগে
আর জাগে তরোয়াল,
দপ্দপ্ করে ঘিয়ের দীপ জাগে-
কার এসেছে কাল?”
নীলকমলের নাম শুনিয়া খোক্কসেরা ভয়ে তিন হাত পিছাইয়া গেল! নীলকমল আর জন্মে রাক্ষসী-রাণীর পেটে হইয়াছিল, তাই তাঁর শরীরে কি-না রাক্ষসের রক্ত! খোক্কসেরা তাহা জানিত। সকলে বলিল,-“আচ্ছা নীলকমল কি-না পরীক্ষা কর।”