রাণী বলিলেন,-“কি, কি?”
রাজা বলিলেন,-“কে, কে?”
রাজ্যের প্রজারা ছুটিয়া আসিল। রাজপুত্র- রাজকন্যা বিবাহ করিয়া লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন!!
কাঁপিতে কাঁপিতে রাজা আসিয়া রাজপুত্রকে বুকে লইলেন। পড়িতে-পড়িতে রাণী আসিয়া রাজকন্যাকে বরণ করিয়া নিলেন।
প্রজারা আনন্দধ্বনি করিয়া উঠিল।
রাজপুত্র রাজার চোখে সোনার কাঠি ছোঁয়াইলেন, রাজার চোখ ভাল হইল। ছেলেকে পাইয়া, ছেলের বউ দেখিয়া রাণীর অসুখ সারিয়া গেল।
তখন, রাজপুত্র লইয়া ঘুমন্ত পুরীর রাজকন্যা লইয়া, রাজা-রাণী সুখে রাজত্ব করিতে লাগিলেন।
ঠাকুরমা’র ঝুলি
-বাঙ্লা-মা’র বুক-জোড়া ধন-
এত কি ছিল ব্যাকুল মন।
-ওগো।-
ঠাকুরমা’র বুকের মানিক, আদরের ‘খোকা খুকি’।
চাঁদমুখে হেসে, নেচে নেচে এসে, ঝুলির মাঝে দে উঁকি!
ওগো!
সুশীল সুবোধ, চারু হারু বিনু লীলা শশী সুকুমারি!
দ্যাখ তো রে এসে খোঁচা খুঁচি দিয়ে ঝুলিটারে
নাড়ি’ চাড়ি।’
-ওগো!-
বড় বৌ, ছোট বৌ। আবার এসেছে ফিরে’
সেকালের সেই রুপকথাগুলো তোমার আঁচল ঘিরে’!
ফুলে ফুলে বয় হাওয়া, ঘুমে ঘুমে চোখ ঢুলে,
কাজগুলো সব লুটুপুটি খায় আপন কথার ভুলে।
এমন সময় খুঁটে লুটে’ এনে হাজার যুগের ধূলি
চাঁদের হাটের মাঝখানে’-মা!-ধূপুষ্ করা-
ঝুলি!!
হাজার যুগের রাজপুত্র রাজকন্যা সবে
রপসাগরে সাঁতার দিয়ে আবার এল কবে!
হাঁউ মাঁউ কাঁউ শব্দ শুনি রাসেরি পুর-
না জানি সে কোন্ দেশে না জানি কোন্ দূর!
নতুন বৌ! হাঁড়ি ঢাক’, শিয়াল পন্ডিত ডাকে;-
হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা কোন্ রানীদের পাপে?
তোমাদেরি হারাধন তোমাদেরি ঝুলি
আবার এনে ঝেড়ে’ দিলাম সোনার হাতে তুলি’!
ছেলে নিয়ে মেয়ে নিয়ে কাজে কাজে এলা-
সোনার শুকের সঙ্গে কথা দুপুর সন্ধ্যা বেলা,
দুপুর সন্ধ্যা বেলা লক্ষ্মি! ঘুম যে আসে ভূলি’!
ঘুম ঘুম ঘুম,
-সুবাস কুম্ কুম্-
ঘুমের রাজ্যে ছড়িয়ে দিও
ঠাকুরমা’র
এ
ঝুলি।
গাছের আগায় চিক্মিক্
আমার খোকন্ হাসে ফিক্-ফিক্।
নীলাম্বরীখান গায়ে দিয়ে, খোকার-মাসি এসেছে!
নদীর জলে খোকার হাসি ঢেলে’ পড়েছে!
আয় রে আমার কাজ্লা বুধি, আয় রে আমার হুমো,-
গাছের আড়ে থামল রে চাঁদ, আমার, সোনার মুখে চুমো !
ঘরে ঘরে রক্ষ্মীমণির পিদিম জ্বলছে,
নাচ্বে খোকা, নিবে প্রসাদ খোকন্ আমার গঙ্গাপ্রসাদ-
কোন্ স্বর্গের ছবি খোকন্ মর্ত্তে এনেছে?
ও খোকন, খোকন্ রে।
আর নেচো না, আর নেচো না নাচন ভেঙ্গে পড়েছে!-
দেখ্সে’ আঙ্গিনায় তোর কে এসেছে!
আঙ্গিনেয় এলো চাঁদের মা দেখ্সে’ খোকন্ দেখে যা,
ঝুলির ভেতর চাঁদের নাচন্ ভরে’ এনেছে।
ঝুলির মুখ খোলা,-খোকার হাসি তোলা-তোলা-
ঠাকুরমা’র কোলটি জুড়ে কে রে বসেছে?
দুধের সাগর
হাজার যুগের রাজপুত্র রাজকন্যা সবে
রূপসাগরে সাঁতার দিয়ে আবার এল কবে।
* * *
শুকপঙ্খী নায়ে চড়ে’ কোন কন্যা এল’
পাল তুলে’ পাঁচ ময়ূরপঙ্খী কোথায় ডুবে, গেল,
পাঁচ রানী পাঁচ রাজার ছেলের শেষে হল কি,
কেমন দুভাই বুদ্ধু, ভূতুম, বানর পেঁচাটি!
নিঝুম ঘুমে পাথর-পুরী-কোথায় কত যুগ-
সোনার পদ্মে ফুটে’ ছিল রাজকন্যার মুখ!
রাজপুত্র দেশ বেড়াতে’ কবে গেল কে-,
কেমন করে’ ভাঙ্গল সে ঘুম কোন পরশে!
ফুটল কোথায়, পাঁশদাগাতে সাত চাঁপা, পারুল,
ছুটে এল রাজার মালী তুলতে গিয়ে ফুল,
ঝুপ্ ঝুপ্ ঝুপ্ ফুলের কলি কার কোলেতে?
হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা কাদের পাপে!
রাখাল বন্ধুর মধুর বাঁশি আজকে পড়ে মনে-
পণ করে পণ ভাঙ্গল রাজা; রাখাল বন্ধুর সনে।
গা-ময় সুচ, পা-ময় সুচ-রাজার বড় জ্বালা,-
ডুব দে’ যে হলেন দাসী রানী কাঞ্চনমালা!
মনে পড়ে দুয়োরানীর টিয়ে হওয়ার কথা,
দুঃখী দুভাই মা হারা সে শীত-বসন্তের ব্যথা।
ছুটতে কোথায় রাজার হাতী পাটসিংহাসন নিয়ে;
গজমোতির উজল আলোর রাজকন্যার বিয়ে!
বিজন দেশে কোথায় যে সে ভাসানে, ভাই-বোন
পড়ল অবাক্ অতুল পুরী পরম মনোরম!
সোনার পাখি ভাঙ্গল স্বপন কবে কি গান গেয়ে-
লুকিয়ে ছিল এসব কথা ‘দুধ সাগরের’ ঢেউয়ে!
নীলকমল আর লালকমল
এক রাজার দুই রাণী; তাহার এক রাণী রাক্ষসী! কিন্তু, এ কথা কেহই জানে না।
দুই রাণীর দুই ছেলে;-লক্ষ্মী মানুষ-রাণীর ছেলে কুসুম, আর রাক্ষসী-রাণীর ছেলে অজিত। অজিত কুসুম দুই ভাই গলাগলি।
রাক্ষসী-রাণীর মনে কাল, রাক্ষসী-রাণীর জিভে লাল। রাক্ষসী কি তাহা দেখিতে পারে?-কবে সতীনের ছেলের কচি কচি হাড়-মাংসে ঝোল অম্বল বাঁধিয়া খাইবে;-তা পেটের দুষ্ট ছেলে সতীন-পুতের সাথ ছাড়ে না। রাগে রাক্ষসীর দাঁতে-দাঁতে কড় কড় পাঁচ পরাণ সর্ সর্।-
যো না পাইয়া রাক্ষসী ছুতা-নাতা খোঁজে, চোখের দৃষ্টি দিয়া সতীনের রক্ত শোষে।
দিন দন্ড যাইতে না যাইতে লক্ষ্মীরাণী শয্যা নিলেন।
তখন ঘোমটার আড়ে জিভ্ লক্লক্ আনাচে কানাচে উঁকি।
দুই দিনের দিন লক্ষ্মীরাণীর কাল হইল। রাজ্য শোকে ভাসিল। কেহ কিচ্ছু বুঝিল না।
অজিতকে “সর্ সর্” কুসুমকে “মর্ মর্’,-রাক্ষসী সতীন-পুতকে তিন ছত্রিশ গালি দেয়, আপন পুতকে ঠোনা মারিয়া খেদায়!
দাদাকে নিয়া গিয়া অজিত নিরালায় চোখের জল মুছায়-“দাদা, আর থাক্ আর আমরা মার কাছে যাব না। রাক্ষসী-মা’র কাছে আর কেহই যায় না! লোহার প্রাণ অজিত সব সয়; সোনার প্রাণ কুসুম ভাঙ্গিয়া পড়ে। দিনে দিনে কুসুম শুকাইতে লাগিল।