কিরণমালা অরুণের তরোয়ালে মরিচা দেখিয়া কাঁদিয়া অস্থির। বরুণের তীর ধনুক তুলিয়া নিয়া বলিল,-“হে ঈশ্বর। বরুণদাদা যেন অরুণদাদাকে নিয়া আসে।”
১১
যাইতে যাইতে বরুণ মায়া পাহাড়ের দেশে গেলেন। অমনি চারিদিকে বাজনা বাজে, অপ্সরী নাচে,-পিছন হইতে ডাকের উপর ডাক-
“রাজপুত্র! ফিরে’ চাও! ফিরে চাও! কথা শোন!”
বরুণ ফিরিয়া চাহিতেই পাথর হইয়া গেলেন-“হায় দাদাও আমার পাথর হইয়াছেন।”
আর হইয়াছেন;-কে আসিয়া উদ্ধার করিবে? অরুণ বরুণ জন্মে মত পাথর হইয়া রহিলেন।
ভোরে উঠিয়া কিরণমালা দেখিলেন তীরের ফলা খসিয়া গিয়াছে। ধনুর ছিলা ছিঁড়িয়া গিয়াছে-অরুণদাদা গিয়াছে, বরুণদাদাও গেল। কিরণমালা কাঁদিল না, কাটিল না, চরে জল মুছিল না; উঠিয়া কাজললতাকে খড় খৈল দিল, গাছ-গাছালির গোড়ায় জল দিয়া, রাজপুত্রের পোশাক পরিয়া, মাথে মুকুট হাতে তরোয়াল,-কাজললতার বাছুরকে, হরিণের ছানাতে চুমু খাইয়া, চরে পলক ফেলিয়া কিরণমালা মায়া পাহাড়ের উদ্দেশে বাহির হইল।
যায়,-যায়,-কিরণমালা আগুণের মত উঠে, বাতাসের আগে ছাটে; কে দেখে, কে না-দেখে! দিন রাত্রি, পাহাড় জঙ্গল, রোদ বান সকল লুটালুটি গেল; ঝড় থম্কাইয়া বিদ্যুৎ চম্কাইয়া তের রাত্রি তেত্রিশ দিনে কিরণমালা পাহাড়ে গিয়া উঠিলেন।
অমনি চারিদিক দিয়া দৈত্য, দানব, বাঘ, ভালুক, সাপ, হাতী, সিংহ, মোষ, ভূত-পেত্নীতে আসিয়া কিরণমালাকে ঘিরিয়া ধরিল।
এ ডাকে,-“রাজপুত্র, তোকে গিলি!”
এ ডাকে,-“রাজপুত্র, তোকে খাই!”
“হাম্….হুম্!….হাঁই!
“হম্….হম্!….হঃ!”
“হুম্….হাম্!….!”
“ঘঁ:!……..”
পিঠের উপর বাজনা বাজে,-
“তা কাটা ধা কাটা
ভ্যাং ভ্যাং চ্যাং-
রাজপুত্রের কেটে নে
ঠ্যাং!’
করতাল ঝন্ ঝন্-
খরতাল খন্ খন্-
ঢাক ঢোল-মৃদঙ্গ্ কাড়া-
ঝক্ ঝক্ তরোয়াল, তর্ তর্ খাঁড়া-
অপ্সরা নাচে,-“রাজপুত্র, রাজপুত্র এখনো শোন্!”
মায়ার তীর,-ধনুকে ধনুকে ঢানে গুণ;-
উপরে বৃষ্টি বজ্রের ধারা, মেঘের গর্জন ল কাড়া,-শব্দে, রবে আকাশ ফাটিয়া পড়ে, পাহাড় পর্বত উল্টে, পৃথিবী চৌচির যায়!-সাত পৃথিবী থর থর কম্পমান,-বাজ, বজ্র-শিল,-চমক……….।
নাঃ! কিছুতেই কিছু না!- সব বৃথায়, সব মিছায়!- কিরণমালা তো রাজপুত্র ন’ন, কিরণমালা কোনদিকে ফিরিয়া চাহিল না, পায়ের নিচে কত পাথর টলে গেল, কত পাথর গলে গেল-চরে পাতা নামাইয়া তরোয়াল শক্ত করিয়া ধরিয়া, সোঁ সোঁ করিয়া কিরণমালা সর্সর্ একেবারে সোনার ফল হীরার গাছের গোড়ায় গিয়া পৌঁছিল।
আর অমনি হীরার গাছে সোনের পাখি বলিয়া উঠিল,-“আসিয়াছ? আসিয়াছ? ভালই হইয়াছে। এই র্ঝণার জল নাও, এই ফুল নাও, আমাকে নাও, ওই যে তীর আছে নাও, ওই যে ধনুক আছে নাও, দেরি করিও না; সব নিয়া, ওই যে ডঙ্কা আছে, ডঙ্কায় ঘা দাও।”
পাখির এক-এক কথা বলে, কিরণমালা এক-এক জিনিস নেয়। নিয়া গিয়া, কিরণমালা ডঙ্কায় ঘা দিল।”
সব চুপ্চাপ্! মায়া পাহাড় নিঝুম। খালি কোকিলের ডাক, দোয়েলের শীস্, ময়ূরের নাচ!
তখন পাখি বলিল,-
“কিরণমালা, শীতল র্ঝণার জল ছিটাও!”
কিরণমালা সোনার ঝারি ঢালিয়া জল ছিটাইলেন, ত চারিদিকে পাহাড় মড়মড় করিয়া উঠিল, সকল পাথর টক্ টক্ করিয়া উঠিল,-যেখানে জলের ছিটা-ফোঁটা পড়ে, যত যুগের যত রাজপুত্র আসিয়া পাথর হইয়াছিলেন, চরে পলকে গা-মোড়া দিয়া উঠিয়া বসেন।
দেখিতে-দেখিতে সকল পাথর ল ল রাজপুত্র হইয়া গেল। রাজপুত্রেরা জোড় হাত করিয়া কিরণমালাকে প্রণাম করিল,-
“সাত যুগের ধন্য বীর!”
অরুণ বরুণ চোখের জলে গলিয়া বলিলেন,-“মায়ের পেটের ধন্য বোন্।”
“অরুণ বরুণ কিরণমালা
তিনটি ভুবন করলি আলা!”
১২
পুরীতে আসিয়া অরুণ বরুণ কিরণমালা কাজললতাকে ঘাস-জল দিলেন, কাজললতাকে বাছুর খুলিয়া দিলেন, হরিণছানা নাওয়াইয়া দিলেন, আঙ্গিনা পরিস্কার করিলেন, গাছের গোড়ায় গোড়ায় জল দিলেন, জঞ্জাল নিলেন,-দিয়া নিয়া, বাগানে রূপার গাছের বীর হীরার গাছের ডাল পুঁতিলেন, মুক্তা র্ঝণা-জলের ঝারীর মুখ খুলিলেন, মুক্তার ফল ছড়াইয়া দিলেন; সোনার পাখিকে বলিলেন,-“পাখি! এখন গাছে বস।”
তর্ তর্ করিয়া হীরার গাছ বড় হইল, ফর্ ফর্ করিয়া রূপার গাছ পাত মেলিল, রূপার হালে হীরার শাখে টুক্টুকেটুক্ সোনার ফল থোবায় দুলিতে লাগিল; হীরা ডালে সোনার পাখি বসিয়া হাজার সুরে গান ধরিল। চারিদিকে মুক্তার ফল থরে থরে চম্-চম্ তারি মধ্যে শীতল র্ঝণায় মুক্তার জল ঝর্ ঝর্ করিয়া ঝরিতে লাগিল।
পাখি বলিল,-“আহা!”
অরুণ বরুণ কিরণ তিন ভাই-বোন গলাগলি করিলেন।
১৩
বনের পাখি পারে না, বনের হরিণ পারে না, তা মানুষে কি থাকিতে পারে? ছুটিয়া আসিয়া দেখে-“আঃ! যে পুরী-পুরী। ইন্দ্রপুরী পৃথিবীতে নামিয়া আসিয়াছে।”
খবর রাজার কাছে গেল। শুনিয়া রাজা বলিলেন,-“তাই না কি! সে ব্রাহ্মণের ছেলেরা এমন সব করিল।”
সে রাতে সোনার পাখি বলিল,-“অরুণ বরুণ কিরণমালা! রাজাকে নিমন্ত্রণ কর।”
তিন ভাই-বোন্ বলিলেন,-“সে কি! রাজাকে নিমন্ত্রণ করিয়া কি খাওয়াইব?”
পাখি বলিল,-“সে আমি বলিব!”
অরুণ বরুণ ভোরে গিয়া রাজাকে নিমন্ত্রণ করিয়া আসিলেন।
সোনার পাখি বলিল,-“কিরণ! রাজা মহাশয় যেখানে খাইতে বসিবেন, সেই ঘরে আমাকে টাঙ্গাইয়া দিও।”
কিরণ বলিল,-“আচ্ছা।”
১৪
ঠাট কটক নিয়া, জাঁকজম করিয়া, রাজা নিয়ন্ত্রণ খাইতে আসিয়া দেখেন,-কি!!-রাজা আসিয়া দেখেন…আর চম্কেন; দেখেন…আর ‘থ’ খান। পুরীর কানাচে কোণে যা’, রাজভান্ডার ভরিয়াও তা নাই। “এসব এরা কোথায় পাইল?-এরা কি মানুষ!-হায়!!” একবার রাজা আনন্দে হাসেন, আবার রাজা দুঃখে ভাসেন-আহা, ইহারাই যদি তাঁহার ছেলেমেয় হইত!