ব্রাহ্মণের আর কি? কিরণমালা মায়ে ডালিভরা ফুল আসে, দীপ চন্দন দেয়। ধূপ জ্বালাইয়া ঘন্টা নাড়িয়া ব্রাণ “বম্-বম্” করিয়া পূজা করেন!
এমনি করিয়া দিন যায়। অরুণ-বরুণ ব্রাহ্মণের সকল বিদ্যা পড়িলেন; কিরণমালা ব্রাহ্মণের ঘরসংসার হাতে নিলেন।
তখন একদিন তিন ছেলে-মেয়ে ডাকিয়া, তিনজনের মাথায় হাত রাখিয়া ব্রাহ্মণ বলিলেন-“অরুণ, বরুণ, মা কিরণ, সব তোদের রহিল, আমার আর কেনো দুঃখ নাই,-তোমাদিগে রাখিয়া এখন আমি আর এক রাজ্যে যাই; সব দেখিয়া শুনিয়া খাইও।” তিন ভাই বোনে কাঁদিতে লাগিলেন, ব্রাহ্মণ স্বর্গে চলিয়া গেলেন।
৮
মনের দুঃখে মনের দুঃখে দিন যায়,-রাজার রাজপুরী অন্ধকার। রাজা বলিলেন,-“না! আমার রাজত্ব পাপে ঘিরিয়াছে। চল, আবার মৃগয়ায় যাইব।” আবার রাজপুরীতে মৃগয়ায় ডঙ্কা বাজিল।
রাজা মৃগয়ায় গিয়াছেন আর সেই দিন আকাশের দেবতা ভাঙ্গিয়া পড়িল। ঝড়ে, তুফানে, বৃষ্টি বাদলে-সঙ্গী সাথী ছাড়াইয়া, পথ পাথার হারাইয়া ঘুরঘুট্রি অন্ধকার, ঝম্ঝম্ বৃষ্টি-বৃক্ষের কোটরে রাজা রাত্রি কাটাইলেন।
পরদিন রাজা হাঁটেন, হাটেন, পথের শেষ নাই। রৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ, দিক্ দিশা খাঁ খাঁ; জল মনুষ্য কোথায়, জল জলাশয় কোথায়,-হাঁপিয়া জাপিয়া তৃষ্ণায় আকুল রাজা দেখেন, দূরে এক বাড়ি। রাজা সেই বাড়ির দিকে চলিলেন।
অরুণ বরুণ কিরণমালা তিন ভাই-বোন্ দেখে,-কি-এক যে মানুষ, তাঁর হাতে পায়ে গায়ে মাথায় চিক্চিক্! দেখিয়া, অরুণ বরুণ অবাক হইল; কিরণ গিয়া দাদার কাছে দাঁড়াইল।
রাজা ডাকিয়া বলিলেন,-“কে আছ, একটুকু জল দিয়া বাঁচাও।”
ছুটিয়া গিয়া, ভাই-বোনে জল আনিল। জল খাইয়া, অবাক রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন,-“দেবপুত্র দেবকন্যা-বিজন দেশে তোমার কে?”
অরুণ বলিল,-“আমরা ব্রাহ্মণের ছেলেমেয়ে!”
রাজার বুক ধুকু ধুকু, রাজার মন উসু খুসু-‘ব্রাহ্মণের ঘরে এমন ছেলেমেয়ে হয়!’- কিন্তু রাজা কিছু বলিতে পারিলেন না, চাহিয়া চাহিয়া, দেখিয়া দেখিয়া, শেষে চক্ষের জল পড়ে-পড়ে। রাজা বলিলেন,-“আমি জল খাইলাম না, দুধ খাইলাম! দেখ বাছারা, আমি এই দেশের দুঃখী রাজা। কখনও তোমাদের কোন কিছুর জন্য যদি কাজ পড়ে, আমাকে জানাইও, আমি তা’ করিব।” বলিয়া, রাজা নিশ্বাস ছাড়িয়া উঠিলেন।
তখন কিরণ বলিল, -” দাদা! রাজার কি থাকে?”
অরুণ বরুণ বলিল ,- “হাতী থাকে, ঘোড়া থাকে,-অট্রালিকা থাকে।”
কিরণ বলিল, “হাতী ঘোড়া কোথায় পাই; অট্রালিকা বানাও।”
অরুণ বরুণ বলিল, “আচ্ছা”।
৯
“আচ্ছা”-দিন কোথায় দিয়া যায়, রাত্রি কোথায় দিয়া যায়, কোন রাজ্য থেকে কি আনে, মাথার ঘাম মাটিতে পড়ে, ুধা নাই, তৃষ্ণা নাই, বারো মাস ছত্রিশ দিন চাঁদ সূর্য ঘুরে’ আসে, অরুণ বরুণ যে অট্রালিকা বানায়। অরুণ বরুণ কাজ করে, কিরণমালা বোন্ ভরা ঘাটের ধরা জল হাঁড়িতে হাঁড়িতে ভরিয়া আনিয়া দেয়। বারো মাসে ছত্রিশ দিনে, সেই অট্রালিকা তৈয়ার হইল।
সে অট্রালিকা দেখিয়া ময়দানব উপোস্ করে, বিশ্বকর্মা ঘর ছাড়ে-অরুণ বরুণ কিরণের অট্রালিকা সূর্যের আসল ছোঁয়, চাঁদের আসন কাড়ে! শ্বেতপাথর ধব্ ধব্, শ্বেতমাণিক রব্ রব্; দুয়ারে দুয়ারে রূপার কবাট, চূড়ায় চূড়ায় সোনার কলসি! অট্রালিকার চারদিকে ফুলে গাছ, ফলের গাছ-পী-পাখালিতে আঁটে না। মধুর গন্ধে অট্রালিকা র্ভুর্ভু, পাখির ডাকে অট্রালিকা মধুরপুর! অরুণ বরুণ কিরণের বাড়ি দেবে দৈত্য চাহিয়া দেখে!
একদিন এক সন্ন্যাসী নদীর ওপার দিয়া যান! যাইতে যাইতে সন্ন্যাসী বলেন,-
“বিজন দেশের বিজন বনে কে-গো বোন্ ভাই?-
কে ‘গড়েছ এমন পুরী, তুলনা তার নাই।”-
পুরী হইতে অরুণ বলিলেন,-
“নিত্য নূতন চাঁদের আলো আপ্নি এসে পড়ে,
অরুণ বরুণ কিরণমালা ভাই-বোন্টির ঘরে!”
সন্ন্যাসী বলিলেন,-
“অরুণ বরুণ কিরণমালার রাঙা রাজপুরী’
দেখতে সুখ শুনতে সুখ ফুট্ত আরো ছীরি’।
এমন পুরী আরো কত হত মনোলোভা,
কি যেন চাই, কি যেন নাই, তাইতো না হয় শোভা।
এমন পুরী,-রূপার গাছে ফল্বে সোনার ফল।
ঝর্-ঝরিয়ে পড়বে ঝরে মুক্তা-ঝরার জল।
হীরার গাছে সোনার পাখির শুনব মধুস্বর-
মাণিক-দানা ছড়িয়ে রবে পথের কাঁকর।
তবে এমন পুরী হবে তিন ভুবনের সার,-
সোনার পাখির এক-এক ডাকে সুখের পাথার।”
শুনিয়া, অরুণ-বরুণ-কিরণ ডাকিয়া বলিলেন,-
“কোথায় এমন রূপার গাছ,
কোথায় এমন পাখি,
কোথায় সে মুক্তা-ঝরা,
বল্লে এনে রাখি।”
সন্ন্যাসী বলিলেন,-
“উত্তর পূর্ব, পূবের উত্তর
মায়া-পাহাড় আছে,
নিত্য ফলে, সোনার ফল
সত্যি হীরার গাছে
ঝর্-ঝরিয়ে, মুক্তা-ঝরা
শীতল বয়ে যায়,
সোনার পাখি, বসে আছে
বৃক্ষের শাখায়!
মায়ার পাহাড়, মায়ার ঢাকা।
মায়ায় মারে তীর-
এ সব যে, আনতে পারে
সে বড় বীর!”
বলিতে বলিতে সন্ন্যাসী চলিয়া গেলেন।
অরুণ বরুণ বলিলেন,-“বোন, আমরা এ সব আনিব।”
১০
অরুণ বলিলেন,-“ভাই বরুণ, বোন কিরণ, তোরা থাক্ আমি মায়া পাহাড়ে গিয়া সব নিয়া আসি।” বলিয়া অরুণ, বরুণ কিরণের কাছে এক তরোয়াল দিলেন,-“যদি দেখ যে তরোয়ালে মরিচা ধরিয়াছে, তো জানিও আর বাঁচিয়া নাই।” তরোয়াল রাখিয়া অরুণ চলিয়া গেলেন।
দিন যায়, মাস যায়, বরুণ কিরণ রোজ তরোয়াল খুলিয়া খুলিয়া দেখেন। একদিন, তরোয়াল খুলিয়া বরুণের মুখ শুকাইল; ডাক দিয়া বলিলেন,-‘বোন্? দাদা আর এ সংসারে নাই! এই তীর ধনুক রাখ, আমি চলিলাম। যদি তীরের আগা খসে, ধনুর ছিলা ছিঁড়ে, তো জানিও আমিও নাই।”