-বলিয়া বুড়ি ‘হোঁৎ’ করিয়া নাকে ভিতর হইতে পাঁচ গন্ডা লোহার কলাই বাহির করিয়া লাল-নাতুকে খাইতে দিল।
লাল তো আগেই জানেন;-চুপে চুপে লোহার কলাই কোঁচড়ে পুরিয়া, কোঁচড়ের সত্যিকার কলাই কটর্ কটর্ করিয়া চিবাইলেন! বুড়ি দেখিল, সত্যি তো, লাল টুক্টুক্ নাতুই তো। বুড়ি তখন গদ্গদ্,-দুই নাতু কোলে নিয়া বুলায়, ঢুলায়, কয়-
“আঁইয়া মাঁইয়া নাঁতুর
লাঁলু নীলু কাঁতুর্
নাঁতুর বাঁলাই দূরে যাঁ!”
-কিন্তু লালকমলের শরীরে মনুষ্যের গন্ধ!-কোটর চোক অস্গস্ জিভ বার বার খস্-খস্, আয়ীর মুখের সাত কলস লাল্ গলিল! তা নাতু? তা’ কি খাওয়া যায়? বুড়ি কুয়োমুখে লাড় টুকু খাইতে খাইতে খাইল না। শেষে নাতু নিয়া আয়ী বাড়ি গেল!
৮
-সে কি পুরী!- রাজ্যজোড়ে। সেই ‘অছ্নি অভিন্’ পুরী রাক্ষসে কিল্বিল্। যত রাক্ষসে পৃথিবী ছাঁকিয়া জীবজন্তু মারিয়া আনিয়া পুরী ভরিয়া ফেলিয়াছ। লাল নীল, রাক্ষসের কাঁধে চড়িয়া বেড়ান আর দেখেন,-গাদায় গাদায় মরা, গাদায় গাদায় জরা! পচায়, গলায় পুরী গদ্ গদ্ থক্ থক্ -গন্ধে বালো ভূত পালায়, দেব দৈত্য ডরায়! দেখিয়া লাল বলিলেন,-“ভাই, পৃথিবী তো উজাড় হইল।”
নীল চুপ করিয়া রহিলেন,-“নাঃ পৃথিবী আর থাকে না!’ তখন, নিশি রাত্রে, যত নিশাচর রাক্ষস, সাত সমুদ্রের ঐ পারে যত রাজ-রাজ্য উজাড় দিতে গিয়াছে; এক কাচ্চা-বাচ্চাও পুরীতে নাই; নীলকমল উঠিয়া, লালকমলকে নিয়া পুরীর দক্ষিণ কূয়োর পাড়ে গেলেন। গিয়া, নীল বলিলেন,-“দাদা, আমার কাপড়-চোপড় ধর।”
কাপড় দিয়া, নাল, কূয়োয় নামিয়া এক খড়গ আর এক সোনার কৌটা তুলিলেন। কৌটা খুলিতেই জীয়নকাঠি মরণকাঠি দুই ভীমরুল ভীমরুলী বাহির হইল।
জীয়নকাঠি মরণকাঠি-ভীররুল ভীমরুলীর, গায়ে বাতাস লাগিতেই, মাথা কন্-কন্ বুক চন্-চন্, রাক্ষসের মাথায় টনক্ পড়িল; বোকা রাজার দেশে রাক্ষসী-রাণী ঘুমের চোখে ঢুলিয়া পড়িল।
মাথার টনক্ বুকে চমক্; দীঘল দীঘল পায়ে রাক্ষসেরা নদী পবর্ত এড়ায়, ধাইয়া ধাইয়া আসে! দেখিয়া নীলকমল জীয়নকাঠির পা ছিঁড়িয়া দিলেন। যত রাক্ষসের দুই পা খসিয়া পড়িল।
দুই হাতে ভর, তবু রাক্ষস ছুটিয়া ছুটিয়া আসে-নীলকমল জীয়নকাঠির আর চার পা ছিঁড়িয়া ফেলিলেন। যত রাক্ষসের হাত খসিয়া পড়িল
হাত নাই পা নাই, তবু রাক্ষস,-
“হাঁউ মাঁউ কাঁউ!
সাঁত শঁত্তুর খাঁউ!!-”
-বলিয়া পড়াইয়া গড়াইয়া ছোটে। খড়গের ধারে ধরিয়া নীলকমল জীয়নকাঠির মাথা কাটিলেন। আর যত রাক্ষসের মাথা ছুটিয়া পড়িল। আয়ীবুড়ির মাথাটা,-ছিটকাইয়া পড়িয়া নীল লালকে ধরে-ধরে গিলে-গিলে।
তখন রাক্ষস-পুরী খাঁ খাঁ;-আর কে থাকে? নীলকমল লালকমল আয়ীবুড়ির মাথা নূতন কাপড়ে জড়াইয়া, মরণকাঠি ভীমরুলের সোনার কৌটা নিয়া, “বেঙ্গম, বেঙ্গম!”- বলিয়া ডাক দিলেন।
৯
তিন মাস তের রাত্রির পর দুই ভাইয়ের পা দেশে পড়িল। দেশের সকলে জয় জয় করিয়া উঠিল!
নীলকমল লালকমল বলিলেন,-“সিপাইরা কৈ? ওষুধ নাও!”
সিপাইরা কি আছে? আই আর কাই তো রাক্ষস ছিল! তারা সেইদিন-ই মরিয়াছে। নীলকমল লালকমল আপন সিপাই বুকে খিল পিঠে খিল রাজার দেশে রাসের মাথা পাঠাইয়া দিলেন।
“ও-মা!!”-মাথা দেখিয়াই রাণী-নিজ মূর্তি ধারণ করিল-
“করম্ খাম্ গরম খাম্
মুড়মুড়িয়ে হাড্ডি খাম্!
হম্ ধম্ ধম্ চিতার আগুন
তবে বুকের জ্বালা যাম্!!
বলিয়া রাক্ষসী-রাণী বিকট মূর্তি ধরিয়া ছুটিতে ছুটিতে নীলকমল লালকমলের রাজ্যে গিয়া উপস্থিত হইল।
বাহির দুয়ারে,-“খাম্! খাম্!!”
লাল বলিলেন,-“থাম্ থাম্।” লালকমল মরণকাঠি ভীমরুল আনিয়া-কৌটা খুলিলেন।
গা ফুলিয়া ঢোল,
চোখের দৃষ্টি ঘোল,
মরণকাঠি দেখিয়া, রাক্ষসী, মরিয়া পড়িয়া গেল!
সকলে আসিয়া দেখে,-এটা আবার কি! খোক্কসের ঠাকুর’মা না কি? আমাদের রাজ্যে বুঝি নিমন্ত্রণ খাইতে আসিয়াছেন? সকলে “হো-হো-হো!!” করিয়া উঠিল।
জল্লাদেরা আসিয়া মরা রাক্ষসিটাকে ফেলিয়া দিল।
১০
রাণী মরিল, আর বোকা রাজার রোগ সারিয়া গেল! ভাল হইয়া রাজা রাজ্যে রাজ্যে ঢোল দিলেন।
প্রজারা আসিয়া বলিল,-“হায়! আমাদের সোনার রাজপুত্র অজিত কুসুম কৈ?”
রাজা নিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন,-“হায়! অজিত কুসুম কৈ?”
এমন সময় রাজপুরীর ঢাক ঢোলের শব্দ। রাজা বলিলেন,-“দেখ তো, কি।”
গলাগলি দুই রাজপুত্র আসিয়া রাজার গায়ে প্রণাম করিল। রাজা বলিলেন,-“তোরা কি আমার অজিত কুসুম?”
প্রজারা সকলে বলিল,-“ইহারাই আমাদের অজিত কুসুম!”
তখন দুই রাজ্য এক হইল; নীলকমল লালকমল ইলাবতী লীলাবতীকে লইয়া, দুই রাজা সুখে কাল কাটাইতে লাগিলেন।
রূপ-তরাসী
‘হাঁ-উ মাঁ-উ কাঁ-উ’ শুনি রাক্ষসেরি পুর
না জানি সে কোন্ দেশে-না জানি কোন্ দূর!
রূপ দেখতে তরাস লাগে, বলতে করে ভয়,
কেমন করে’ রাক্ষসীরা মানুষ হয়ে রয়!
চ-প্ চ-প্ চিবিয়ে খেলে আপন পেটের ছেলে,
সোনার ডিম লোহার ডিম কৃষাণ কোথায় পেলে!
কেমন করে’ ধ্বংস হল খোক্কসের পাল-
কেমন করে উঠ্ল কেঁপে নেঙ্গা তরোয়াল!
পায়ের নিচে কড়ির পাহাড় হাড়ের পাহাড় চুর-
রাজপুত্র কে গিয়াছে পাশাবতীর পুর?
হিল্ হিল্ হিল্ কাল্-নিশিতে-গর্জে কোথায় সাপ-
সাজার পুরীর ধ্বংস কোথায় হাজার সিঁড়ির ধাপ!
আকাশ পাতাল সাপের হাঁ কোথায় পাহাড় বন,
থর্ থর্ থর্ গাছের ডালে বন্ধু দুজন!
চরকা কোথায় ঘ্যাঁর্ঘ ঘ্যাঁর্ঘ-পেঁচোর কিবা রূপ,-
মণির আলোয় কোন্ কন্যার অগাধ জলে ডুব’।
“হী হী হী!” হরিণ-মাথা রাক্ষস আকার।
আমের ভিতর রাজার ছেলে লুকিয়ে ছিল কে,
রাজকন্যা, নিয়ে এল সাগর পারে গে’!
কবে কোথায় রাক্ষসীর হাড় মুড্ মুড্ করে
রাজার ছেলের রসাল কচি মুন্ডু খাবার তরে!-
রাক্ষসের বংশ উজাড় রাজপুত্রের হাতে-
লেখা ছিল সে সব কথা ‘রূপতরাসী’র পাতে।
শীত বসন্ত
১