রাক্ষস-খোক্কসেরা নানা রকম ছলনা চাতুরী করে’ সকলের বড় খোক্কসেটা সেই সব আরম্ভ করিল। বলিল,-তোঁদের নঁখেঁর ডাঁগাঁ দেঁখিঁ?”
লাল, নীলের মুকুটটা তরোয়ালের খোঁচা দিয়া বাহির করিয়া দিলেন। সেটা হাতে করিয়া খোক্কসেরা বলাবলি করিতে লাগিল-বাঁপ্ রেঁ! ঐ যাঁর নঁখের ডঁগাঁ এঁমঁন, না জাঁনি সেঁ কিঁ রেঁ!
তখন আবার বলিল,-দেঁখি তোঁদেঁর থুঁ থুঁ কেঁমঁন।”
লালকমল তরোয়াল প্রদীপের ঘি গরম করিয়া ছিটাইয়া দিলেন। খোক্কসদের লোম পুড়িয়া গন্ধে ঘর ভরিল; খোক্কসেরা আবার আসিয়া বলিল,-“তোঁদেঁর জিঁভঁ দেঁখিবঁ।”
লাল, নীলের তরোয়ালখানা দুয়ারের ফাঁক দিয়া বাড়াইয়া দিলেন। বড় খোক্কস দুই হাতে তরোয়াল ধরিয়া, আর সকল খোক্কসকে বলিল,-“এঁইবাঁর জিঁভ্ টানিয়া ছিঁড়িবঁ, তোঁরাঁ আঁমাঁকে ধঁরিঁয়াঁ জোঁরেঁ টাঁন্-ন্-ন্।”
সকলে মিলিয়া খুব জোরে টানিল, আর তর্তর্ ধার নেঙ্গা তরোয়ালে বড় খোক্কসের দুই হাত কাটিয়া কালো রক্তের বান ছুটিল! চেচাঁইয়া মেচাইয়া সকল খোক্কস ডিঙ্গাইয়া বড় খোক্কস পলাইয়া গেল!
অনেকক্ষণ পরে বড় খোক্কস আবার কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া বলিল,-“কেঁ জাঁগেঁ, কে জাঁগেঁ?”
কতক্ষণ খোক্কস আসে নাই, লালকমলের ঘুম পাইতেছিল; লালকমল ভুলে বলিয়া ফেলিলেন,-
“লালকমল জাগে, আর-”
মুখের কথা মুখে,-দুয়ার কবাট ভাঙ্গিয়া সকল খোক্কস লালকমলের উপর আসিয়া পড়িল। ঘিয়ের দীপ উল্টিয়া গেল, লালের মাথার মুকুট পড়িয়া গেল;
লাল ডাকিলেন-“ভাই!”
নীলকমল জাগিয়া দেখেন,-খোক্কস! গা মোড়ামুড়ি দিয়া নীল বলিলেন,-
“আরামকাকাঠি জিরামকাঠি, কে জাগিস্ রে?
দ্যাখ তো দুয়ারে মোর ঘুম ভাঙ্গে কে!”
নীলকমলের সাড়ায় আ-খোক্কস ছা-খোক্কস সকল খোক্কস আধমরা হইয়া গেল। নীলকমল উঠিয়া ঘিয়ের দীপ জ্বালিয়া দিয়া সব খোক্কস কাটিয়া ফেলিলেন। সকলের বড় খোক্কসটা নীলকমলের হাতে পড়িয়া, যেন, গিরগিটির ছা!
খোক্কস মারিয়া হাত মুখ ধুইয়া দুই ভাইয়ে নিশ্চিতে ঘুমাইতে লাগিলেন।
পরদিন রাজা গিয়া দেখিলেন, দুই রাজপুত্র রক্তজবার ফুল-গলাগলি হইয়া ঘুমাইতেছেন; চারিদিকে মরা খোক্কসরে গাদা। দেখিয়া রাজা ধন্যধন্য করিলেন। রাজার রাজত্ব ও জোড়া রাজ-কন্যা দুই ভাইয়ের হইল।
৬
সেই যে রাক্ষসী-রাণী? রাজার পুরীতে থানা দিয়া বসিয়াছে তো? আই-রাক্ষস কাই-রাক্ষস তাঁর দুই দূত দিয়া খোক্কসের মরণ-কথার খবর দিল। শুনিয়া রাসী-রাণী হাঁড়িমুখ ভারি করিয়া বুকে তিন চাপড় মারিয়া বলিল,-“আই রে! কাই রে! আমি তো আর নাই রে!-
-ছাই পেটের বিষ-বড়ি
সাত জন্ম পরাণের অরি-
ঝাড়ে বংশে উচ্ছন্ন দিয়া আয়!”
অমনি আই কাই, দুই সিপাইর মূর্তি ধরিয়া নীলকমল লালকমল রাজসভায় গিয়া বলিল,-“বুকে খিল পিটে খিল, রাক্ষসের মাথায় তেল না হইলে তো আমাদের রাজার ব্যারাম সারে না।”
লালকমল নীলকমল কহিলেন,-“আচ্ছা, তেল আনিয়া দিব।”
নূতন তরোয়ালে ধার দিয়া, দুই ভাই রাক্ষসের দেশের উদ্দেশে চলিলেন।
যাইতে যাইতে, দুই ভাই এক বনের মধ্যে গিয়া উপস্থিত হইলেন। খুব বড় এক অশ্বত্থ গাছ হায়রাগ হইয়া দুই ভাইয়ে অশ্বত্থের তলায় বসিলেন।
সেই অশ্বত্থ গাছে বেঙ্গমা-বেঙ্গমী পীর বাসা। বেঙ্গমী বেঙ্গমাকে বলিতেছে,-
“আহ, এমন দয়াল কাঁরা, দুই ফোঁটা রক্ত দিয়া আমার বাছাদের চোখ ফুটায়!”
শুনিয়া, লাল নীল বলিলেন,-“গাছের উপরে কে কথা কয়?-রক্ত আমরা দিতে পারি।”
বেঙ্গমী “আহ্ আহা” করিল।
বেঙ্গম নিচে নামিয়া আসিল।
দুই ভাই আঙ্গুল চিবিয়া রক্ত দিলেন।
রক্ত নিয়া বেঙ্গম বাসায় গেল; একটু পরে সাঁ সোঁ করিয়া দুই বেঙ্গম বাচ্চা নামিয়া আসিয়া বলিল,-“কে তোমরা রাজপুত্র আমাদের চোখ ফুটাইয়াছ? আমরা তোমাদের কি কা করিব বল।”
নীল লাল বলিলেন,-“আহা, তোমরা বেঁচে থাক : এখন আমাদের কোনই কাজ নাই।”
বেঙ্গম-বাচ্চারা বলিল,-“আচ্ছা, তা তোমরা, যাইবে কোথায় চল, আমরা পিঠে করিয়া রাখিয়া আসি।”
দেখিতে দেখিতে ডাঙ্গা জাঙ্গাল, নদ নদী, পাহাড়-পর্বত, মেঘ, আকাশ, চন্দ্র, সূর্য সকল ছাড়াইয়া, দুই রাজপুত্র পিঠে বাচ্চারা হু হু করিয়া শূন্যে উড়িল।
৭
শূন্যে শূন্যে সাত দিন সাত রাত্রি উড়িয়া আট দিনের দিন বাচ্চারা এক পাহাড়ের উপর নামিল। পাহাড়ের নিচে ময়দান, ময়দান ছাড়াইলেই রাক্ষসের দেশ। নীলকমল গোটাকতর কলাই কুড়াইয়া লালকমলের কোঁচড়ে দিয়া বলিলেন,-“লোহার কলাই চিবাইতে বলিলে এই কলাই চিবাইও!”
নীল লাল আবার চলিতে লাগিলেন।
দুই ভাই ময়দান পার হইয়া আসিয়াছেন-,আর-,
“হাঁউ মাঁউ! কাউঁ!
এনিষ্যির গঁন্ধ পাঁউ!!
ধঁরে ধঁরে খাঁউ!!!”
-করিতে করিতে পালে পালে ‘অযুতে-নিযুতে রাক্ষস ছুটিয়া ছুটিয়া আসিতে লাগিল। নীলকমল চেঁচাইয়া বলিলেন,-“আয়ী মা! আয়ী মা! আমরাই আসিয়াছি- তোমার নীলকমল, কোলে করিয়া নিয়া যাও!”
“বঁটে বঁটে, থাঁম্ থাঁম্ !” বলিয়া রাসদিগকে থামাইয় এ-ই লম্বা লম্বা হাত পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে, ঝাঁকার জট কাঁপাইতে কাঁপাইতে, হাঁপাইয়া ‘জটবিজটি’ আয়ীবুড়ি আসিয়া নীলকমলকে কোলে নিয়া-“আমার নীল! আমরা নাঁতু!’ বলিয়া আদর করিতে লাগিল। আয়ীর গায়ের গন্ধে নীলুর নাড়ি উলটিয়া আসে। লালকে দেখিয়া আয়ীবুড়ি বলিল,-“ওঁ’ তোঁর সঁঙ্গে কেঁ র্যাঁ?”
নীলু বলিলেন,- “ও আমার ভাই লো আয়ীমা, ভাই!”
বুড়ি বলিল,-
“তাঁ কেঁন মঁনিষ্যি মঁনিষ্যি গন্ধ পাঁই?
আঁমার নাঁতু হঁয় তো চিবিয়ে খাঁক্
নোঁহার কঁলাই।”