শওকত সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসেভাবে হাসলেন। কিছু বললেন না।
তোমার সঙ্গে বসে যে দুটো কথা বলব সে উপায় তো নেই। মুখ সেলাই করে বসে থাকবে। আশ্চর্য এক মানুষের সঙ্গে জীবন কাটালাম!
মনোয়ারা উঠে চলে গেলেন। ঘরের ভেতর থেকে এখন গানের কথা ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে ওস্তাদ টিচার প্রথম দিনেই গান শেখাচ্ছেন
তুমি বাস কি না তা আমি জানি না
ভালোবাস কি না তা আমি জানি না
আমার কাজ আমি বন্ধু করিয়া যে যাব
চিন্তা হইতে আমি চিতানলে যাব…
শওকত সাহেব একা বসে আছেন। রাতে ভাত খাবার ডাক না আসা পর্যন্ত একাই বসে থাকতে হবে। আয়নাটা বের করে মেয়েটার সঙ্গে দুটা কথা বললে কেমন হয়? কেউ এসে দেখে না ফেললে হল। দেখে ফেললে সমস্যা।
কেমন আছ চিত্ৰলেখা?
জ্বি, ভালো আছি। কে গান গাচ্ছে?
আমার বড় মেয়ে।
ইরা?
হ্যাঁ, ইরা। তোমার দেখি নাম মনে আছে!
মনে থাকবে না কেন? আমার সবার নামই মনে আছে ইরা, সোমা, কল্পনা। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার খুব মন-খারাপ। আপনার কী হয়েছে?
কিছু হয়নি রে মা।
শওকত সাহেবের গলা ধরে এল। দিনের পর দিন তাঁর মন খারাপ থাকে। কেউ জানতে চায় না তার মন-খারাপ কেন—আয়নার ভেতরের এই মেয়ে জানতে চাচ্ছে। তাঁর চোখে প্রায় পানি আসার উপক্রম হল। তিনি প্রসঙ্গ পালটাবার জন্যে বললেন, তুমি কি গান জান?
জ্বি না।
আস্থা শোনো, তুমি যে বলেছিলে খিদে লেগেছে। কিছু কি খেয়েছ? খিদে কমেছে?
মেয়েটা মিষ্টি করে হাসল। মজার কোনো কথা বলছে এমন ভঙ্গিতে বলল, আপনি কী যে বলেন! খাব কী করে? আমাদের এখানে কি কোনো খাবার আছে?
খাবার নেই?
না। কিছু নেই। এটা একটা অদ্ভুত জায়গা। শুধু আমি একা থাকি। কথা বলারও কেউ নেই। শুধু আপনার সঙ্গে কথা বলি।
শওকত সাহেব লক্ষ করলেন, মেয়েটা আগের মতো দুহাত বুকের উপর রেখে থরথর করে কাঁপছে। তিনি কোমল গলায় বললেন, শীত লাগছে মা?
লাগছে। এখানে খুব শীত। যখন বাতাস দেয় তখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগে। আমার তো শীতের কাপড় নেই। এই একটাই ফ্ৰক।
দুঃখে শওকত সাহেবের চোখে প্রায় পানি এসে গেল। তখন মনোয়ারা বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। শীতল গলায় বললেন, আয়না হাতে বারান্দায় বসে আছ কেন? কল্পনার পাশে বসে তার পড়াটা দেখিয়ে দিলেও তো হয়। সব বাবারাই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা দেখিয়ে দেয়, একমাত্র তোমাকে দেখলাম অফিস থেকে এসে বটগাছের মত বসে থাক। বাবার কিছু দায়িত্ব তো পালন করবে।
শওকত সাহেব আয়নাটা রেখে কল্পনার পড়া দেখানোর জন্যে উঠে দাঁড়ালেন।
সাজেদুল করিম অসাধ্য সাধন করেছে
সাজেদুল করিম অসাধ্য সাধন করেছে। শওকত সাহেবকে কম্পিউটার শিখিয়ে ফেলেছে।
কী স্যার, বলিনি আপনাকে শিখিয়ে ছাড়ব?
শওকত সাহেব হাসলেন। তাঁর নিজের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তিনি ব্যাপারটা ধরে ফেলেছেন। সাজেদুল করিম বলল, আর কোনো সমস্যা হবে না। তা ছাড়া আমি আপনার জন্যে আরেকটা কাজ করেছি—প্রতিটি স্টেপ কাগজে লিখে এনেছি। কোনো সমস্যা হলে কাগজটা দেখবেন। দেখবেন, সব পানির মতো পরিষ্কার।
থ্যাংক য়্যু।
আর স্যার, আমার ঠিকানাটা কাগজে লিখে গেলাম। কোনো ঝামেলা মনে করলেই আমার বাসায় চলে আসবেন।
আচ্ছা। বাবা, তুমি অনেক কষ্ট করেছ।
আপনার অবস্থা দেখে আমার স্যার মনটা খারাপ হয়েছিল। রাতে দেখি ঘুম আসে না। তখন একের পর এক স্টেপগুলি কাগজে লিখলাম। সারারাত চিন্তা করলাম কীভাবে বোঝালে আপনি বুঝবেন।
শওকত সাহেবের চোখে প্রায় পানি আসার উপক্রম হল। তিনি ভেবে পেলেন না এরকম অসাধারণ ছেলে পৃথিবীতে এত কম জন্মায় কেন?
স্যার, আমি যাই। জিএম সাহেবকে বলে যাচ্ছি আপনি সব শিখে ফেলেছেন, আর কোনো সমস্যা নেই। আরেকটা কথা স্যার, কম্পিউটারকে ভয় পাবেন না। তাকে ভয় পাবার কিছু নেই। কম্পিউটার হচ্ছে সামান্য একটা যন্ত্ৰ। এর বেশি কিছু না।
শওকত সাহেবের চোখে এইবার সত্যি সত্যি পানি চলে এল। ছেলেটা যেন চোখের পানি দেখতে না পায় সেজন্যে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে মনে ঠিক করলেন, আজ অফিস থেকে ফেরার পথে ছেলেটার জন্যে একটা উপহার কিনবেন। দামি কিছু না, সেই সামর্থ্য তাঁর নেই, তবু কিছু কিনে তার বাসায় গিয়ে তাকে দিয়ে আসবেন। একটা কলম বা এই জাতীয় কিছু। শদুই টাকার মধ্যে কলম না পাওয়া গেলে সুন্দর কিছু গোলাপ। তাঁর সঙ্গে পাঁচশো টাকা আছে। টেবিলের ড্রয়ারে খামের ভেতর রাখা।
শওকত সাহেব একশো পঁচাত্তর টাকা দিয়ে একটা ওয়াটারম্যান কলম কিনলেন। তারপর কোনোকিছু না ভেবেই চিত্ৰলেখার জন্যে একটা সুয়েটার কিনে ফেললেন। গরমের সময় বলেই ভালো ভালো সুয়েটার সস্তায় বিক্রি হচ্ছিল। সুয়েটার কিনতে তিনশো চল্লিশ টাকা খরচ হয়ে গেল। শাদা জমিনের উপর নীল ফুল আঁকা। সিনথেটিক উল। দোকানদার বলল, সিনথেটিক হলেও আসল উলের বাবা। শুধু সুয়েটার গায়ে দিয়েই তুন্দ্রা অঞ্চলে বরফের চাইয়ের উপর শুয়ে থাকা যায়। শওকত সাহেব জানেন সুয়েটার কেনাটা তার জন্যে খুবই বোকামি হয়েছে। চিত্ৰলেখাকে এই সুয়েটার তিনি কখনো দিতে পারবেন না। কারণ চিত্ৰলেখা বলে কেউ নেই। পুরো ব্যাপারটা তার মাথার অসুস্থ কোনো কল্পনা। সংসারের দুঃখধান্ধায় তাঁর মাথা এলোমোনলা হয়ে যাচ্ছে বলে এইসব হাবিজাবি দেখছেন। তার পরেও মনে হল—মেয়েটা দেখবে জিনিসটা তার জন্যে কেনা হয়েছে। বেচারি খুশি হবে।