সুবিমলের জীবনের সবকিছু ঘটনা সে নিজেই বুঝে নিয়েছে। কারণ রাতে যখন তখন পার্কে বসে সুবিমল বার বার বেঘোরে আবোল তাবোল বকে। সুবিমলকে দেখলেই তার ছেলের কথা মনে পড়ে। বুকের ভেতরে স্নেহ ভালবাসার এক আর্তি অনুভব করে সে। তাই সুবিমলের প্রতি তার এত টান।
প্রশস্ত গলি পেরিয়ে বাসায় পৌঁছে সুবিমল দেখে, ঘরের ভেতর অন্ধকার। সে দরজার কড়া নাড়ে। সুবিমলের স্ত্রী মাধুরী লাইট অন করে চটপট দরজা খুলে বলে, কি ব্যাপার এত রাত করলে যে? এখন কটা বাজছে জান? ওই দেখ সাড়ে এগারোটা। মাধুরী দেওয়ালে ঘড়ির দিকে চোখ তুলে সুবিমলকে ইঙ্গিত করে। সুবিমল নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মাধুরীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। যেন অনেকদিন দেখেনি তাকে। মাধুরী সুবিমলের বিধ্বস্ত, ক্লান্তিভরা, বিষণ্ণ মুখের দিকে চেয়ে ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে, সুবিমলকে হাত ধরে ঘরে টেনে নিয়ে যায়। চেয়ারে বসিয়ে বলে, নিশ্চয় আজও তুমি পার্কে গিয়েছিলে? আর পারি না বাবা তোমাকে নিয়ে। আমি ভাবলাম সুনীলদার সঙ্গে টালিগঞ্জে গেছ, হয়ত সেখানেই দেরি হচ্ছে। তাই আমি আর খুঁজতে বের হইনি। তারপর কপট রাগের ভান করে বিরক্তির সুরে বলে, এতই যদি বিজয়ার প্রতি তোমার ভালবাসা ছিল, তাহলে আমাকে বিয়ে না করলেই পারতে? দিনের পর দিন তোমার এ পাগলামি আমার আর সহ্য হয় না। এ রকম করলে বুবুনকে নিয়ে আমি বাপের বাড়ি চলে যাব। মাধুরী জানে এ সময় সুবিমলকে সে যদি বিদ্রূপ ও অপমানের কথার চাবুক না মারে তবে সে সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ হবে না। এ প্রেসক্রিপশান সাইকিয়াটিস্ট ডাঃ অমর ঘোষের। গোপনে মাধুরীকে তিনি বলে দিয়েছেন। মাধুরী দু’চারবার এইরকম কয়েকটা কড়া কথা শোনাবার পর সুবিমল প্রকৃতিস্থ হয় এবং বলে, হ্যাঁ-হ্যাঁ তাই যেয়ো। দিনের পর দিন তোমার এই অপমান আমার আর সহ্য হয় না।
দু’এক মিনিট স্বামী স্ত্রীতে বাকযুদ্ধ হয়। মাধুরী লক্ষ্য করে সুবিমল আজ যেন অন্যরকম। অন্যদিন সুবিমল মর্মাহত হয়ে ক্ষমা চেয়ে তাকে কাছে টেনে নেয়। কিন্তু আজ তা তো করলই না, উপরন্তু তেজোদীপ্ত কন্ঠে প্রতিবাদের যেন ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। তাই মাধুরী নিজেই নরম হয়ে, সুবিমলের কাছে এগিয়ে ডান হাতটা তুলে নিয়ে বলে, তোমার গল্পটা নিল? অ্যাডভান্স করেছে?
সুবিমল গম্ভীরভাবে বলে, না।
—তাহলে উপায়? তিন মাস ভাড়া বাকি। আজ বাড়িওয়ালা এসেছিল। বলেছে ভাড়া দিতে না পারলে যেন অন্য ঘর দেখে। বুবুনের স্কুলের মাইনেও দুমাস বাকি পড়ে গেছে। বাজারে আর ধারের কোন জায়গা নেই। আমি কি যে করি। মাধুরী একের পর এক আর্থিক পরিস্থিতির কথা বলে যায়। কিন্তু সুবিমল নিরুত্তর।
এক সময় টিং টিং শব্দ করে ঘড়িতে বারটা বাজে। মাধুরী বিচলিত হয়। সে জানে সুবিমল যা অভিমানী এখন আর কোন উত্তর দেবে না। স্বামীর প্রতি মমতা আর ভালবাসায় চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে। নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, আমি খাবার আনছি, তুমি হাত মুখ ধুয়ে এস। সুবিমল মাধুরীর অন্তর্দাহ কোথায় ভালভাবে বোঝে। তাই চেয়ার থেকে উঠে নিঃশব্দে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায়।
বিছানায় শুয়ে সুবিমলের ঘুম আসে না। সুনীল বোস, রণধীর চৌধুরী, ধর্ষণের গল্প, বিজয়া, মাধুরী, বাহাদুর, বুবুনের স্কুলের মাইনে, বাড়িভাড়া প্রভৃতি হাজার চিন্তা ক্রমান্বয়ে ঘুরে ফিরে আসে। আসে যায়-আবার আসে। চিন্তা তার মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষকে উত্তপ্ত করে। যখন ঘুম এল তখন রাত প্রায় চারটে। তাও পাতলা, ছেঁড়া ছেঁড়া। ঘুমের মধ্যে সুবিমল আবার দেখতে পায় বিজয়াকে। তবে অন্যরকমভাবে। নাইট শো সিনেমা দেখে বিজয়া আর সে হেঁটে চলেছে গ্রামে ঢোকার আলপথ ধরে। নির্মল আকাশে মাঘী পূর্ণিমার চাঁদ। জ্যোৎস্না যেন গলে গলে পড়ছে দুব্বো ঘাসের মাথায়, ধান, আলু সর্ষেক্ষেত্রে বুকে। অদ্ভুত সুন্দর মায়াময় পৃথিবী। পৃথিবীর এমন সুন্দর রূপ গ্রামের ছেলে হয়েও ইতিপূর্বে সে কোনদিন দেখেনি, উপলব্ধি করেনি। রাস্তার পাশে বুড়ো আশুধ গাছ। গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে একটি লক্ষ্মী পেঁচা উড়ে যায়। বিজয়া লক্ষ্য করে বলে, আজ লক্ষ্মী পুজো, দেখ কি উড়ে গেল? সুবিমল বলে, লক্ষ্মী পেঁচা। বিজয়া মুখে আঙুল তুলে বলে, ইস নাম করে ফেললে। আজ না পুজো। দিলে তো সাঁতটা মাটি করে। কথা বলতে বলতে ওরা এসে পড়েছিল বটপুকুরের পাড়ে। বটপুকুরের বটগাছটা অনেক দিনের পুরনো। জনশ্রুতি দু’আড়াইশো অথবা তারও পূর্বের। ঝুরি, গাছের পাতা, কুল ঝোঁপ, সেঁকুল ঝোঁপ ঘিরে কিছুটা পথ ঘন ছায়ার অন্ধকারে আবৃত। ছায়া দু’জনের শরীর স্পর্শ করতেই কোন কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই হিংস্রপশুর মত কারা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের ওপর। চিৎকার করার সুযোগ না দিয়ে গামছা, দড়ি দিয়ে বেঁধে, বিজয়াকে টেনে নিয়ে যায় সামান্য দূরে। সুবিমল স্পষ্ট দেখে, প্রথমে ওরা শাড়ি পরে ব্লাউজ মাংসল জায়গা শকুনের মত খুবলে খুবলে খাচ্ছে। তারপর একে একে চারজন বলাৎকার করল বিজয়াকে। মুখে কালিঝুলি মাখায় ওরা ভেবেছিল চিনতে পারবে না। কিন্তু আবাল্য পরিচিত কণ্ঠস্বর, হাত, পা, শরীরের গঠন কি লুকানো যায়? সে সহজেই চিনে নেয় নিমাই, কালু, ঝন্টে আর পদাকে। কামনা চরিতার্থ করার পর হিংস্র পশুদের সেই শানি—। মুহূর্তে দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়। সুন্দর সাজানো গোছানো ঘরে, অদ্ভুত গোল হাঁড়ির মত মাথা, চওড়া গোঁফ, পুরুষ্টু মাংসলহাত একজন লোক, মাধুরীকে জাপটে ধরে শুইয়ে দিল নরম গদিওয়ালা বিছানায়। তারপর একে একে খুলে ফেলল শরীরের সব কিছু আবরণ। সে স্পষ্ট দেখতে পায় মাধুরীর গোল দুধসাদা দুটি স্তন খামচে ধরে দলাই মলাই করছে দৈত্যাকৃতি লোকটি। কিন্তু কি আশ্চর্য মাধুরী কোন বাধা দিচ্ছে না। মাধুরীর দু’হাতে একশ টাকার দুটি নোটের বান্ডিল। মুখে একই সঙ্গে রমণ ও গুপ্তধন পাওয়ার স্নিগ্ধ কোমল পরিতৃপ্ত হাসি। শরীরের শক্ত দড়ির বাঁধন ঘেঁড়ার জন্যে সুবিমল প্রাণপণ চেষ্টা করে ঠোঁটের ওপর ঠোঁট চাপে। ঠোঁট কেটে লাল রক্তের ফোঁটা বিন্দু বিন্দু আকারে ঝরে পড়ে—প্রথমে পাঞ্জাবিতে, পাঞ্জাবি বেয়ে ট্রাউজারে। ট্রাউজার সিক্ত হলে মাটিতে। হঠাৎ সুবিমল পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি, ইউরেকা-ইউরেকা, শব্দে ভয়ঙ্কর চিৎকার করে উঠে বসে বিছানায়। তীব্র চিৎকারে মাধুরীর ঘুম ভেঙে যায়। ক্ষিপ্রগতিতে উঠে বসে সুবিমলকে জড়িয়ে ধরে ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, কি পেয়ে গেছ?