—কি যাতা বলছ সুবিদা। তোমার কি দোষ, সবই আমার নিয়তি।
–না না বিজয়া, তোকে নিয়ে যদি না সেদিন সিনেমা দেখতে যেতাম, তাহলে হয়ত…
–সিনেমাটা উপলক্ষ্য মাত্র। যা ঘটার সেদিন না ঘটলেও অন্যদিন ঘটত।
—বিজয়া!
বিজয়ার কথায় বিস্ময়ে সুবিমলের রোম খাড়া হয়। নিজেকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বলে, মা বাবার কথায় সেদিন আমি কাপুরুষের মত পালিয়ে এসেছিলাম দেশ থেকে কলকাতার হোস্টেলে। যারা তোকে ধর্ষণ করেছিল, তাদের আমি চিনতে পেরেও ভয়ে নাম করিনি। ওরা আমাকে শাসিয়েছিল, নাম করলে আমার বোনকে ধর্ষণ করে..
–তুমি ঠিকই করেছ সুবিদা। আমার জন্যে অনিমাদির জীবনটাও হয়ত ফুরিয়ে যেত অকালেই। আমি তো ওদের চিনি। ওরা অনিদিকে ছেড়ে দিত না। আমার মত দুদে, সাহসী, বেপরোয়া মেয়েকে যদি ওরা…।
—তুই কি বলছিস বিজয়া আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তাই বলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কি আমার উচিত ছিল না?
—হয়ত ছিল। কিন্তু রুখে দাঁড়িয়েই বা কি করতে? তোমার ও তোমাদের সংসারের অনেকের জীবন বিপন্ন হত। অনিদিরও কিছু একটা ঘটে যেতে পারত। তাছাড়া বাবা তো অত কিছু করেও কিছু করতে পারলেন না ওদের। পার্টি, পুলিশ কেউ তো কিছু করল না। এমনকি কেউ অ্যারেস্ট পর্যন্ত হল না। পার্টির ছত্রছায়ায় ওরা এখন দিব্বি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লজ্জায়, অপমানে বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। আমি শেষ পর্যন্ত—তবে শেষটায় তোমাকে একবার দেখার জন্যে মন প্রাণ আকুল হয়ে উঠেছিল। তাই গোপনে মাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম, সব শেষ হয়ে গেলেও, তুমি যেন এসে একবার আমাকে দেখে যাও।
–কিন্তু আমি যে নিরন্তর আজও যুদ্ধ করে চলেছি নিজের সঙ্গে। আমার তো উচিত ছিল, যেখানে তোর কোন কিছু দোষ ছিল না, সেখানে তোর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। বিয়ে করে….
—হাসালে সুবিদা। আমাদের দেশটা তো, ইউরোপ আমেরিকা নয়। তোমার বিবেক বললেও, প্রাণ চাইলেও, সমাজ, তোমার বাবা, মা, আত্মীয়স্বজন কেউ মেনে নিত না। এক জ্বালা জুড়ালেও হাজার জ্বালায় আমাকে জ্বলে পুড়ে মরতে হত। আমার যা ব্যক্তিত্ব, প্রতিমুহূর্তে অন্তসত্তায় আঘাত লাগত। শেষে গায়ে কেরোসিন ঢেলে কিংবা গলায় দড়ি দিয়ে…তখন তুমি বিপদে পড়তে।
—বি-জ-য়া!
–যা সত্যি, তাই বললাম। সত্য আর বাস্তব বড় কঠিন গো সুবিদা। কল্পনায় আবেগে, অনেক কিছু বলা যায়। করেও ফেলা যায় অনেক কিছু। কিন্তু তার পরিণাম হয় ভয়াবহ। যাক, আমি চললাম। আর হয়ত কখনও দেখা হবে না তোমার সঙ্গে। সংসার করেছ, সন্তান হয়েছে, সংসারটা সামলাও। আমার জন্যে খামোকা চিন্তা করে আর শরীর মন খারাপ করো না। অতীত নিয়ে ভেবো না। ওই দেখ, আমার সঙ্গীরা উদগ্রীব হয়ে উঠেছে আমার জন্যে। আমার আর এক মুহূর্ত এখানে থাকা চলবে না। চলি কেমন। বিজয়া উঠে দাঁড়ায়।
–প্লিজ বিজয়া, আর একটু-আর এক মিনিট বোস। আমার দু-একটা কথা তোকে এখনও জিজ্ঞেস করার আছে।
—চটপট বলে ফেল, তোমাকে বোধহয় কেউ খুঁজতে আসছে। ওই দেখ টর্চের আলো।
সুবিমল কি এক ঘোরে গভীর চিন্তায় এতক্ষণ আচ্ছন্ন হয়েছিল। দূর থেকে চার ব্যাটারি টর্চের তীব্র আলো প্রথমে পাশের বেল ফুলের ঝোঁপ ও জলের ওপর, তারপর বিচ্ছুরিত হয়ে তার চোখে এসে পড়ে। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সে মুহূর্তকাল চোখ বুজে, পুনরায় খুলে বিজয়াকে প্রশ্ন করে, তুই আজও আমাকে তেমনি ভালবাসিস?
কিন্তু কোথায় বিজয়া! বাহাদুর ততক্ষণে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যে কনকনে হিমেল বাতাসটা তার সমস্ত অনুভূতি আর সত্তাকে একেবারে আচ্ছন্ন ও অবশ করে দিয়েছিল তা আর নেই। পরিবর্তে সত্তোরতীর্ণ বাহাদুরের স্নেহ কোমল গরম হাতের স্পর্শ তার কাঁধে। বাহাদুর স্নেহার্দ সুরে হিন্দী বাংলায় বলে, বাবুসাব, বহুৎ রাত হো গিয়া। ঘর যাইয়ে। বউদিদিমনি চিন্তা করছেন। সুবিমল বলে, বাহাদুর-দা, বিজয়া-বিজয়া কি চলে গেছে?
বাহাদুর চোখের জল মুছে বলে, হ্যাঁ বাবুসাব, চলা গিয়া। লেকিন আপুনি বাবু ইরকম করলে…যা হবার, যে যাবার সে তো চলা গিয়া। লেকিন, আপুনি শক্ত না হলে পাগল হই যাবেন। সংসার ভি ভেসে যাবে।
ততক্ষণে সুবিমল কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। নিজের মধ্যে ফিরে গিয়ে বলে, হ্যাঁ, হা বাহাদুরদা শেষ পর্যন্ত আমি বোধহয় পাগলই হয়ে যাব।
বাহাদুর সুবিমলের হাত ধরে টেনে তুলে বলে, ছিঃ। উ কথা কখনও মুখে আনবেন না বাবু। আপুনি একটা ডাক্টার দেখান। সব ঠিক হহা জায়েগা।
সুবিমল টলায়মান অবস্থায় পার্কের মোরাম বিছানো রাস্তায় চলতে চলতে বাহাদুরকে বলে, হ্যাঁ, বাহাদুরদা একটা ডাক্তার দেখানো আমার খুব প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত বাহাদুরের ঘর বিহার মুলুকে। পার্কের কোণে যে লায়নস্ ক্লাব আছে, তার নৈশ প্রহরী। থাকে সুবিমলের পাড়ায়। বস্তিতে। রাতে ক্লাব পাহারা, দিনের বেলায় সরকারি ডিপো থেকে দুধ এনে বাড়িতে বাড়িতে দেয়। এতে তার উপরি রোজগার হয়। সুবিমলের বাড়িতেও সে দুধ দিচ্ছে বছর দুই হল। সুবিমলকে সে ভীষণ ভালবাসে। ভালবাসার কারণ; সুবিমলের বয়সী তার একটি ছেলে ছিল। কয়েকবছর আগে বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। বিহার মুলুকের বাড়িতে তার ছেলের বিধবা বৌ শিশুপুত্র নিয়ে থাকে।