—হ্যাঁ-তা ঠিক। তারপর একটু চিন্তা করে সুনীল বোস বলেন, তাহলে কিন্তু গল্পের মোড় অন্যদিকে ঘুরে যেতে পারে দাদা
-কেন-কেন?
—মেয়েটিকে নিয়ে বিরোধীপক্ষ রাজনীতি আরম্ভ করবে। চাকরি দেবে। মানে মেয়েটি এস্টাবলিস্ট হয়ে যাবে।
-হ্যাঁ, তাও তো বটে, তাহলে কি করা যায়…
—কেন হোমে পাঠিয়ে দিলে…আই মিন উদ্ধার আশ্রম?
–ধ্যাৎ, তাহলে স্টোরি একেবারে কেঁচে যাবে। দর্শক খাবে না। আচ্ছা সুবিমলবাবু এরপর আপনি আপনার বুদ্ধি আর লেখার চাতুর্য দিয়ে—মানে আমি বলছিলাম আপনারা লেখক মানুষ—সবকিছুই পারেন, মানে ওই কনক্লসানটুকু পারবেন তো?
সুবিমল বিষণ্ণ, হতাশ অথচ ন দৃষ্টিতে রণধীরবাবুর মুখের দিকে তাকায়। রণধীরবাবু কিছুটা হতাশ হন। সুনীল বোস সুবিমলের চোখের ভাষা ঠিক ঠিক পড়তে
পেরেও বুদ্ধি করে বলেন, হা হা নিশ্চয় পারবেন, কেন পারবেন না। উনি খুব ভাল লেখেন। একবার দেখুন না, ওনার গল্প বড় বড় পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। আসলে উনি একটু সিরিয়াস—মানে উঁচু মানের, যাকে বলে ক্লাসিক-টলাসিক…
—ওসব এখানে চলবে না। এখন যা ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা, বলিউড মার্কা মানে বোম্বের মতঝাড়পিট-সেক্স-নাচ-গান… দেখছেন না ম্যাসিমা বাংলা ছবি ফ্লপ করছে…
সুনীল বোস রণধীরবাবুর কাছে কাজ করছেন বহুদিন। ওনার চরিত্র, মুড, সবকিছুই নখদর্পণে। লোকটি এখন টালিগঞ্জের নামকরা কমার্সিয়াল প্রযোজক কাম পরিচালক। ভদ্রলোক একসময় ভীষণ পরিশ্রম করেছেন। কেরিয়ারিস্ট মনোভাব নিয়ে। নিজেকে তৈরি করেছেন তিল তিল করে। তাই সাকসেস্ এখন হাতের মুঠোয়। ওইসব ক্লাসিক-লাসিক শিল্প-টিল্পর তেমন ধার ধারেন না উনি। ওনার দশ টাকা ইনভেস্ট করলে চাই একশ টাকা। উনি বলেন, সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, গৌতম ওনারা সব অন্য জগতের। ট্যালেন্টেড। আমার জন্যে কমার্স। আমার ছবি মানে আনন্দ-ফুর্তি, যাকে বলে অ্যামিউজমেন্ট। আমি চা বইতে বইতে পরিচালক হয়েছি। অত জ্ঞান আমার কোথায়? ওনার থিওরি, মানি ফ্রম মানি। মানি ইজ গ্রেট। তবে ভীষণ আমুদে আর ফুর্তিবাজ লোক। দু’হাতে যেমন রোজগার করেন ওড়ানও তেমনি। বলেন, ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ। যাবৎ জিবেৎ সুখং জিবেৎ।‘ আজকাল একটু আধটু অন্যরকম ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন। পরিস্থিতির চাপে পড়ে। দর্শক লাইট জিনিষ নিচ্ছে না। তা না হলে নিজেই স্টোরি বানান, স্ক্রিপ্ট করেন। রণধীরবাবু কজি উল্টে ঘড়ি দেখে বলেন, ইস, বড্ড দেরি হয়ে গেল। নটায় পৌষালিকে টাইম দিয়েছিলাম। আমি উঠি সুনীল দা কথা বলতে বলতেই রণধীরবাবু ব্রিফ কে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ান।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি যান। আমি সুবিমলবাবুর সঙ্গে আলোচনা করে নিচ্ছি। সুনীল বোস বিনয়ের সঙ্গে বলেন। বলাবাহুল্য মিস্ পৌষালি ওনার নতুন ছবির নায়িকার জন্যে কনট্রাক্ট ফর্মে সই করেছে গতকালই।
.
২.
রণধীর চৌধুরী স্টুডিও ছেড়ে চলে যাবার পরই ওনারা দুজনে চুপচাপ বাইরে বেরিয়ে
এসে বাস ধরার জন্যে স্টান্ডে অপেক্ষা করেন। বাস আসতে দেরি হওয়ায় নীরবতা ভঙ্গ করে সুনীল বোস সুবিমলকে বলেন, আপনি কি ভুল করে অন্য গল্পের ম্যানস্ক্রিপ্ট নিয়ে চলে এসেছিলেন? তা না হলে—পরক্ষণেই নিজেকে সামনে নিয়ে, সুবিমল যা অভিমানী বলেন, আপনি গল্পটা নিয়ে একটু ভাবুন। ভাল টাকা পাবেন। বিশ হাজার তো বটেইউনি যা লোক, ছবি হিট হলে কিছু বাড়তিও পেয়ে যেতে পারেন।
–না, না, তা কেন হবে। আসলে আমার দ্বারা ওসব ধর্ষণ-উর্ষণ লেখা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
—কেন-কেন? সুনীল বোস বিস্ময়ের সুরে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করেন।
-কেন, তা আপনাকে ঠিক আমি বোঝাতে পারব না। ওসব সেক্স, ধর্ষণ, টর্ষণ লিখতে গেলেই কেমন একটা অস্বস্তি, বিষাদ, আমাকে গ্রাস করে ফেলে। আসলে মানবিকতা, মূল্যবোধ, ন্যায়নীতি-াতিগুলোকে লেখার চরিত্র থেকে আলাদা করে দেখাতে পারি না। তাই লিখতে বসলেই সামাজিক দায়বদ্ধতায় আটকে যায় কলম। বিশেষ করে ধর্ষণের কথা লিখতে গেলেই মাথাটা কেমন গুলিয়ে…।
সুবিমলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ক্যামেরাম্যান সুনীল বোস বলেন, তা হবে হয়ত। হয়ত আপনার মানবিকতাবোধ কিন্তু তাই বলে, সংসারের প্রতিও তো আপনার কিছু দায়িত্ব কর্তব্য আছে। তা তো অস্বীকার করতে পারেন না? তাছাড়া এ লাইনে প্রচার ও পয়সা দুই-ই আছে।
–না, তা পারি না ঠিকই। কিন্তু এভাবে অর্থ উপার্জন করতে আমার কেমন ইগোতে লাগে।
-তাহলে কি আর বলব বলুন। আপনি জ্ঞানী-গুণী লোক। তবু ভেবে দেখবেন আর একবার। সুনীল বোসের গলায় হতাশার সুর। বাস থেকে নেমে কথা বলতে বলতে দু’জনে গালির মুখে একদিকে সুনীল বোস, অন্যদিকে সুবিমল ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। একই পাড়ায় বাড়ি দু’জনের। কয়েকটা বাড়ির তফাৎ মাত্র। সম্পর্কে সুবিমল সুনীল বোসের দুরাত্মীয়।
সুবিমল বাড়িতে না ঢুকে একটু এগিয়ে রাস্তার অনতিদুরে শিবানন্দ পার্কে গিয়ে বসে। এখন রাত প্রায় দশটা। রাস্তা দিয়ে ঘরমুখো দু’চারজন অফিস ফেরতা লোকজন। নিঃশব্দ তাদের চলার গতি। বড় কৃষ্ণচূড়ার সান বাঁধানো গোল চাতালে সুবিমল এখন একা। মৃদু মৃদু বাতাসে দুলছে কৃষ্ণচূড়ার পাতা। পার্কের মাঝখানে চৌকো ঝিলে রুপোলি জ্যোৎস্না গলে গলে মিশে যাচ্ছে। জলের ওপরে দেবদারু, ইউক্যালিপটাশ, কাঠালি চাপার ছায়া। সেই জলছায়ায় জলপরীদের বিহার। আজ বিজয়াও এই দ্বীদের মধ্যে। বিজয়া হাসছে খিল খিল করে। তার স্নিগ্ধ হাসিতে ঝরে পড়ছে মুঠো মুঠো মুক্ত। সুবিমল নৈঃশব্দের বুকে ছড়িয়ে দিল নিজেকে। ভিন্ন জগরে অনুভূতিতে সে আপন করে পেতে চাইল বিজয়াকে। হাত বাড়িয়ে ডাকল। বিজয়া আলোর বন্যা ছড়িয়ে হাসতে হাসতে উঠে এল জল থেকে। বিজয়া কাছে এসে বসতেই সুবিমল তার দুটি কোমল হাত তুলে নিল নিজের হাতে। তারপর করতলে চাপ দিয়ে বলল, আমি তোর প্রতি অন্যায় করেছি বিজয়া অন্যায় করেছি, আমায় ক্ষমা কর তুই।