বেণুকর জন্মাবধি ঠাট্টা বোঝে না বুঝলে কথাটাকে ঠাট্টা মনে করতে পারত—বিস্ময় দুঃসহ হয়ে তার মাথা এমন ঘুরে উঠত না।
শরীর খাড়া করে বেণুকর বলল, “মাছ কোথায় পাবি? যে-মাছ এনে দিলাম তখন, তা কী হলো?’
‘মাছ তুমি কখন আনলে?’
‘মাছ আমি কখন আনলাম? মাছ আনিনি? কুকুর-বেড়াল দিয়ে খাইয়েছিস বুঝি?’
‘নেও, এখন থামো। আর একটু শাক-ঝোল দেই, খেয়ে ফেলো ভাত ক’টি আর খ্যাপামি করো না মাছ-মাছ করে।’
‘খ্যাপামি করব না মাছ-মাছ করে? দে বলছি মাছের ঝোল শিগগির, নইলে ভালো হবে না’ বলে বেণুকর চোখ দুটো এমন লাল করে তুলল যে, তার সম্মুখে প্রতিবাদ আর না চলবারই কথা
কিন্তু জানকী বলল, ‘মন্দই বা কী করতে পারো মিছিমিছি?
মন্দই বা কী করতে পারি মিছিমিছি? এখনও বলছি ভালো ভাবে—রাগাস নে বেশি…’
‘মাছ কোথায় পাবো যে তোমায় ঝোল বেঁধে খাওয়াব? কী মুশকিলেই ফেললে তুমি আমাকে!’
কী মুশকিলেই ফেললাম তোকে, তবে দেখ মুশকিল কাকে বলে।’ বলে বেণুকর এঁটো হাত বাড়িয়ে জানকীর চুল ধরতে যেতেই, তাতেই স্বামীর সেই যৎসামান্য প্রচেষ্টাতেই, ভয় পেয়ে জানকী এমন চিৎকার করল যে, বেণুকরই চমকিয়ে হাত টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
আশেপাশে অনেক লোক বাস করে—
বিপন্না প্রতিবেশিনীর আর্তনাদ শুনে তাদের তিন-চার জন দৌড়ে এলো…
‘মোড়ল রয়েছ? কী হলে ম’ল্যান?’—প্রবীণ নধরগোপাল চৌধুরী উঠোন হতে প্রশ্ন করে এগুতে লাগল।
নধগোপাল চৌধুরী উকিলের মুহুরি ছিল। বৃত্তির পয়সা চুরি করে একবার এবং উকিলের টাকার হিসেব মিলোতে না পেরেও চোখ গরম করায় আর-একবার মার খেয়ে গ্রামে এসে বসেছে। নম্বরের এক ছেলে কলকাতায় এক দোকানে বেচা-কেনার কাজ করে। ভয়ঙ্কর আদালতের ভয়াবহ জটিল সব ব্যাপার তার কাছে জলের মতো পরিষ্কার, এই জন্যে এবং ছেলের মারফৎ কলকাতার আভিজাত্যের সঙ্গে সংযুক্ত বলে নধরের গ্রামে প্রতিপত্তি খুব বিবাদের মীমাংসায় কর্তা সাজতে তার যেমন আনন্দ, তেমন আর কিছুতেই নয়…
এই নধর চৌধুরী বেণুকর এবং জানকীকে প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছে ব্যাপার কী—
কিন্তু রান্নাঘরের ভেতর থেকে বেণুকরের কোনো জবাব আসল না—জবাব দিলো জানকী বলল! ‘আমাকে অনর্থক মারতে উঠেছে।’
‘কেন?’ বলে নধর চৌধুরী প্রভৃতি বেণুকরের রান্নাঘরের সম্মুখে এসে দাঁড়াল…
জানকী মাথার কাপড় একটু টেনে দিলে। বলল, ‘শোনো তোমরা ওকে শুধিয়ে। কী বলছে সব আবোল-তাবোল মাছ-মাছ করে।’
বেণুকর বলল, ‘কী বলছি সব আবোল-তাবোল মাছ-মাছ করে?…শোনো নধরদা, সক্কাল বেলা গেলুম মাঠে লাঙল দিতো দু-বেড় চষতেই দেখি, একটা মাগুর মাছ, এতো বড়ো তাজা মাগুরটা—মাটির ভিতর থেকে উঠে পড়ছে।‘
বিবাদের বিষয়ের জটিলতা দেখে নধর পুলকিত হলো বলল, ‘আচ্ছা। মাটির ভেতর মাগুর মাছ! তারপর?’ বলতেই তার দৃষ্টি বিচারকের দৃষ্টির মতো সূক্ষ্ম হয়ে উঠল।
বাদী বেণুকর বলতে লাগল, ‘ছুটে এলুম ঘরে। বললাম, এই মাছের ঝোল আর ভাত খাবো আজ রাঁধ ভালো করে বলে মাছ ঐ হাঁড়িতে জল দিয়ে রেখে গেলুম আবার মাঠে। …চান করে খেতে বসলাম—দিলো হিঞ্চে শাকের ঝোল খালি। রাগ হয় না মানুষের?’
প্রতিবাদিনী জানকী বলল, ‘শুনলে লোকের কথা! মাছ নাকি এনে দিয়েছে!’
বিচারক নধর চৌধুরী উভয় পক্ষের বাদ-প্রতিবাদ শুনে বলল, ‘বেণু, ভাই, ঠাণ্ডা হও। মাঠের জল শুকিয়েছে কার্তিক মাসে এটা হচ্ছে গিয়ে বোশেখ। মাটির ভেতর মাগুর মাছ তো তাজা কি মরা কোনো অবস্থাতেই থাকতে পারে না।’
‘বললেই হলো থাকতে পারে না! আমি দেখলাম, পেলাম, হাতে করে বাড়ি নিয়ে এলাম—আর তুমি পঞ্চায়েতি করে বলে দিলে আন্দাজের ওপর, থাকতে পারে না!’
সকলে হাসতে লাগল। কালীপদ বলল, ‘মাথা বিগড়েছে।’
জানকী বলল, ‘সেই মাছের ঝোল রাঁধিনি বলে আমায় মারতে উঠেছে।’
‘মারবই তো।’ বলে বেণুকর পুনরায় রুখে উঠতেই কালীপদ প্রভৃতি রান্নাঘরে ঢুকে তাকে ধরে ফেলল।
নধর চৌধুরী বলল, ‘অকারণে মারধোর করো না, বাপু! মাছ তুমি পাওনি। অসম্ভব কথা বললে চলবে কেন? আদালতে এ-কথা টিকবে না। …দেখি চোখ।’ বলে নজর করে বেণুকরের চোখ দেখে নধর চৌধুরী বলল, ‘লাল হয়েছে।’
গুণময় পাল বলল, ‘শুনছ, বেণুকর, হাত ধুয়ে ঠাণ্ডা জায়গায় একটু বসো।–এখুনি সেরে যাবে। বোশেখের রোদ হঠাৎ মাথায় লাগলে চোখে অমন সব ভ্রম লোকে দেখে। সেবার আমারই হয়েছিল অমনি। মাঠ থেকে ফিরছি ঠিক দুপুরবেলা লাঙল আর গোরু দুটো নিয়ে, কিন্তু মনে হচ্ছে, গোরু যেন দুটো নয়, চারটে।’ বলতে বলতে গুণময়ই ঘটিতে করে জল এনে বেণুকরের হাত ধুয়েই তাকে ঠাণ্ডা জায়গায় বসিয়ে দিলো জানকীকে বলল, ভয় নেই, ভালো হয়ে যাবে।’
বেণুকর একবারে নিবে শেষ হয়ে গেলো—তার তখন প্রায় অচেতন অবস্থা…
বারান্দায় সে ঘাড় গুঁজে বসে রইল—হাত নেড়ে জানাল, তোমরা এখন যাও।
প্রতিবেশীগণ বেরিয়ে গেলো—
হিতসাধকগণের অগ্রণী নধর চৌধুরী বলে গেলো, “আর যেন চেঁচামেচি শুনিনে।’
খানিক চুপ করে থেকে জানকী একটু হাসল তারপর বলল, “আঠারো কলা দেখতে চেয়েছিলে! এ তারই একটি …রাগ করে না, তোমার পায়ে ধরি।’ বলে জানকী সত্যই স্বামীর পা ধরে বলল, ‘মাগুর মাছের ঝোল বেঁধেছি। এসো খেতে দি’গে।’
বেণুকর উঠে খেতে গেলো, কিন্তু রাগের জ্বালায় কথা কইল না।