বলদ তার আদেশ বোঝে—চলে থামে তার কথায়। তার আদেশে বলদযুগল লাঙল টেনে চলতে শুরু করল…চতুষ্কোণ ক্ষেত্র বেড়ে লাঙল মন্থর গতিতে চলতে লাগল…লাঙলের জোরে নিচেকার শুষ্ক মাটি পিণ্ডের আকারে উৎপাটিত আর স্বতন্ত্র হয়ে লাঙলের ফালে খনিত মৃত্তিকার দু-পাশে যেন গজিয়ে উঠতে লাগল…দেখতে ভারি আরাম, যেন অপরূপ নূতন কিছুর সৃষ্টি হচ্ছে। বেণুকরের কৃষি-স্ফুর্তি বেড়ে গেলো।
কিন্তু তার কৃষি-স্ফুর্তি স্থায়ী হলো না। লাঙল দুবার ক্ষেত্রের চারকোণ বেড় ঘুরে এসে তৃতীয়বারের মাঝামাঝি আসতেই উন্মুলিত মাটির দিকে চেয়ে বেণুকর বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে রইল…মাটি কেটে আর মাটি ওলোটপালোট করেই লাঙল এই পর্যন্ত এসেছে, কিন্তু ঠিক এই স্থানটিতে লাঙল কেবল নীচের মাটিই উপরে তোলেনি, মাটির নীচ থেকে আরো কিছু তুলেছে…লাঙলের ফালে আধ হাত আড়াই পোয়া মাটির ভেতর থেকে উঠেছে ফুল নয়, ফল নয়, শস্য নয়, শামুক নয়, কচ্ছপের ডিমও নয়, টাকার ঘাটিও নয়, জীবন্ত একটি মাগুর মাছ! কৃষিজীবী বেণুকর মণ্ডল কৃষিকর্ম, বলদ, লাঙল, খেত-খামার, ধান, কলাই, বৃষ্টি, বৈশাখ, ছায়া, রৌদ্র প্রভৃতি সমুদয় বিস্মৃত হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল মাগুর মাছটির দিকে—অপূর্ব আবির্ভাব তা….দেড় পোয়া সাত ছটাক ওজনের জলবাসী মাছ মাটির ভিতরেও কেমন তরতাজা বলিষ্ঠ ছিল। কাত হয়ে কানে হেঁটে মাছটি খোঁড়া মাটির গুঁড়ো আর ঢেলার ভেতর দিয়েই চলবার চেষ্টা করছে।
মাগুরটির দিকে নিষ্পলক চক্ষে তাকিয়ে থেকে থেকে বিস্ময়ের পর বেণুকরের মনে জন্মাল। অনন্ত আনন্দ। এরই নাম অদৃষ্ট—ঈশ্বর যদি দেন তো ছাপ্পর ছুঁড়েই দেন, কথাটা সত্যি কিন্তু তার চাইতেও কল্যাণের কথা এই যে, ঈশ্বর যদি দেন তো মাটির ভিতর সজীব মাগুর মাছ রেখে দেনা ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র মানুষের প্রতিদিনের আহার ব্যাপারের দিকেও ব্রহ্মাণ্ডপতির কেমন নজর দেখো! তুচ্ছ বেণুকর আহার করবে বলে স্নেহবশত তিনি কী আশ্চর্য কাণ্ডই না ঘটিয়েছেন!
লাঙল, বলদ এবং কো-কলকে মাঠে রেখেই বেণুকর মাগুর মাছের মাথা আঙুলে চেপে ধরে আর স্নেহময় ব্রহ্মাণ্ডপতির প্রতি কৃতজ্ঞতায় উদ্বেলিত হয়ে বাড়ির দিকে দৌড়ল…
জানকী হয়তো বৈশাখের অখাদ্য বেগুন ভাজবার আর বড়ি-পোস্ত করবার আর আলু-কুমড়োর টক রাঁধবার কথা ভাবছে। আজ আর সে-সব কিছু নয়—আজ খালি মাগুর মাছের ঝোল আর ভাত—আর কিছু নয়। মাগুর মাছের মাথার চাইতে লেজই মিষ্ট বেশি…
পথে দেখা রাজীব হাজরার সঙ্গে–রাজীবের ইচ্ছা হলো, দাঁড়িয়ে দুটি কথা কয়, আর মাটি মাখা মাগুর মাছ হাতে করে বেণুকরের বাড়ির দিকে দৌড়োবার কারণটা কী তা জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু বেণুকর থামল না—
‘পেয়ে গেলাম দৈবাৎ–’, বলে রাজীবের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাব দিয়ে সে তেমনি দ্রুতপদে অগ্রসর হয়ে গেলো।
পিছনে দুপদাপ শব্দ শুনে জানকী ঝাঁটা থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল–সে উঠোন ঝাঁট দিচ্ছিল চেয়ে দেখল, স্বামী অসময়ে বাড়ি এসেছেন, হাতে তাঁর তাজা মাগুর মাছ, আর মুখময় হাসি।
‘শোন এক তাজ্জব ব্যাপার!’ বলে শুরু করে বেণুকর মৎস্যপ্রাপ্তির ইতিহাস বলল—পরিশিষ্টে নীতি হিসেবে সে এটাও বলল যে ঈশ্বর যখন দেন তখন শুকনো মাটির ভিতর মাগুর মাছ রেখে দেন—খাওয়াবার উদ্দেশে। …তারপর অধিকতর পুলকের সঙ্গে বলল, নে মাছ রাখা এই মাছের ঝোল আর ভাত, আর কিছু না আজ।’
আদ্যন্ত শুনে জানকী প্রশ্ন করল, ‘মাছ কোথায় পেলে গো? দিব্যি মাছটি তো!’
প্রশ্নের জবাবে কথার সুরে আদর ঢেলে বেণুকর বলল, ‘শুনলি কী তবে এতক্ষণ! মাঠে লাঙল দিচ্ছি—হঠাৎ দেখি, মাটির ভেতর থেকে উঠেছে লাঙলের মাটির সঙ্গে এই মাছ!’ বলে সে চোখ বড়ো করে তাকিয়ে রইল।
কিন্তু জানকী এই কথা শুনে বলল, ‘মিছে কথা।’
‘মিছে কথা! তোর দিব্যি, ভগবানের দিব্যি।’
‘তবে রাখো এই হাঁড়ির ভেতর—খানিক জল দিয়ে রাখো।‘
হাঁড়ির ভেতর জল দিয়ে মাগুর মাছ তখনকার মতো জিইয়ে রাখা হলো স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি পরম সহানুভূতির সঙ্গে জল পেয়ে মাছ ক্রীড়াশীল হয়ে উঠেছে—সেই দিকে তাকিয়ে বেণুকর বলল, ‘আজ এই মাছের ঝোল আর ভাত খাবো। সকাল-সকাল ফিরব মাঠ থেকে।’ বলে বেণুকর মাঠের উদ্দেশ্যে ফিরে দাঁড়াল।
যেতে যেতে দরজায় দাঁড়িয়ে হেসে বলল, ‘কী অদেষ্ট দেখ।’
জানকী বলল, ‘হুঁ।’
জানকীর সকাল-সকাল রান্না শেষ হয়েছে। বেণুকরও সকাল-সকাল মাঠ হতে ফিরেছে। — বলল, ‘চান করতে চললাম। ভাত বাড়ো।’
জানকী বলল, ‘বেশ এসো গে।’
মাগুর মাছের ঝোল খাবার ব্যগ্রতায় বেণুকর ষোলো আনা আরাম আদায় করে স্নান করতে পারল না—পুকুরের জলে তাড়াতাড়ি দুটো ডুব দিয়ে সে উঠে পড়ল…
তার ফিরবার সাড়া পেয়ে জানকী জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাত বাড়ব?”
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাপড় ছাড়ছি।’
কাপড় ছেড়ে এসে বেণুকর পিঁড়িতে বসল বলল, ‘আন দেখি।’
জানকী থালায় দিলো ভাত আর বাটিতে দিলো ঝোল।
বেণুকর ঝোলের দিকে চেয়ে বলল, ‘আবার হিঞ্চের ঝোল করেছিস কেন? তোর বড়ো রান্নার শখ।’
জানকী প্রশংসা পেয়েও কথা কইল না—
বেণুকর শাকের ঝোল মেখে বাড়া-ভাতের চার ভাগের এক ভাগ খেয়ে তিন ভাগ রেখে দিলো মাগুর মাছের ঝোলের জন্য বলল, ‘মাছ দে।’
মাঠের মাটির ভেতর মাগুর মাছ পেয়ে বেণুকর যতোই বিস্মিত হোক, দিশেহারা হয়নি–সে বিস্ময়ের অন্ত ছিল, তাতে তার মস্তিষ্কের পরিস্থিতি একেবারে নষ্ট হয়নি কিন্তু মাছ চাওয়ার পর জানকীর কথায় তার যে বিস্ময় জন্মাল সে-বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা মাপ-পরিমাপ ওজন-আধার কিছুই যেন নেই…তা এতোই বেশি! জানকী স্পষ্ট বলল, ‘মাছ কোথায় পাবো?