বেণুকরের গৃহেও এই সময়ে কর্মবিরতি দেখা দিয়েছে বসে বসে নিবিষ্টভাবে হুঁকো টানছে। আর জানকী অদূরে পা মেলে বসে আছে—উভয়েই নীরব। হুকো টানতে টানতে প্রদোষ অথচ শুভ এই সময়ে বেণুকরের দৈবাৎ মনে হলো, জীবনের মধুস্বাদে যে-অপরিমেয় নিবিড়তা ছিল তা যেন আর নেই—তৃষ্ণা যেন নিঃশেষ হয়ে মিটছে না—কে যেন দ্রাক্ষারসে জল ঢেলে দিয়েছে। …তার পূর্বোক্ত ক্ষোভটা অকস্মাৎ পূর্ণবেগে জেগে উঠল।
হুঁকো টানা বন্ধ করে বেণুকর আকাশের দিকে তাকাল—সেখানে কিছুই ছিলো না, কিছুই তার চোখে পড়ল না তেল ফুরিয়ে দীপের শিখা যখন নিবে আসে তখন একটা নিঃশব্দ হাহাকার যেন কোথায় ওঠে, মনে কি শিখায় তার ঠিক নেই…তেমনি একটা পরাজিত অশক্তের শোকের ছায়া যেন আকাশে রয়েছে, কিন্তু বেণুকর মণ্ডলের সে-চোখ নেই যে-চোখে আকাশের বর্ণ, ভাষা, গতি সচেতনভাবে প্রতিফলিত হয়। তবু সে খানিকক্ষণ আকাশের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল…তারপর সে চোখ নামিয়ে তাকাল স্ত্রী জানকীর দিকে তাকিয়ে মলিনভাবে একটু হাসল, যেন একটা উদ্বেগ সে গোপন করতে চায়।
জানকী স্বামীর চোখের ওঠা-নামা লক্ষ করেছিল, জিগগেস করল, ‘কী?’
বেণুকর বলল, ‘কিছু না। তবে শুধোচ্ছিলাম একটা কথা।’
মিষ্ট কণ্ঠে জানকী বলল, ‘বলো শুনি।’
বেণুকর আবার একটু হাসল। তার ধারণা, হাসির দ্বারা তার পশ্চাদবর্তী কথার পথ সুগম হচ্ছে। তারপর বলল, ‘শুনি, মেয়েমানুষের আঠারো কলা—সত্যি নাকি?’
বক্তা কী বলতে চায় তা জানকী তৎক্ষণাৎ বুঝল, বলল, “সত্যি নয়। কলা আঠারো তো নয়ই, তার ঢের বেশি কেউ বলে ছত্রিশ, কেউ বলে চুয়ান্ন।’
দেখা গেলো, জানকী একদা যে কুড়ির ঘর পর্যন্ত নামতা কণ্ঠস্থ করেছিল তা সে বিস্মৃত হয়নি। বেণুকর বিস্মিত হলো, কয়েকবার হুকো টেনে বলল, ‘এতো? কিন্তু তোর তো তার একটাও দেখিনে!’
‘তা আশ্চর্য কী এমন! দেখাইনে তাই দেখো না!’
বেণুকর চুপ করে রইল। একটা মানুষ যা দেখাতে পারে কিন্তু দেখায় না, সেটাকে দেখাও বলে তার কাছে আবদার করা যেতে পারে কিন্তু আবদার করে, আদায় করার মতো জিনিস স্ত্রীলোকের কলা নয়—সংখ্যা তা যতোই হোক।
জানকী জিগগেস করল, ‘কার ঢঙ দেখে ভালো লেগেছে?না কেউ সুর ধরিয়ে দিয়েছে?’
বেণুকর বলিল, ‘তা সব কিছু নয়। অমনি মনে হলো, বললাম।’
‘দেখবে?’
বেণুকর এবার লজ্জা পেলো। মনে মনে যার অভাব অনুভব করে বেণুকর ভূষিত হয়ে উঠেছিল, সেই জিনিসটা দিতে চাইতেই ব্যাপার কেমন বেখাপ্পা হয়ে উঠলা…উদ্দেশ্য প্রচ্ছন্ন থাকে বলে যে-দান অমূল্য করে পাওয়া হয়, তা জানিয়ে-শুনিয়ে দিতে গেলে ভালো লাগে না— কেমন লাগে তা ভাবাই যায় না।
বেণুকর হুকো রেখে মুখ নামিয়ে রইল—
জানকী বলল, ‘চাষার ঘরে কলা! আচ্ছা দেখাব।’
শুনে বেণুকর খুব অপদস্থ হয়ে মুখ ফিরিয়ে প্রস্থান করল।
বৈশাখের শেষ। বৃষ্টিতে মাটি একটু ভিজলেই চাষের কাজ শুরু করা যায়, কিন্তু মেঘের দেখা নেই। বৃষ্টির অভাব দারুণ দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে—এমন সময় দেবতা একদিন দয়া করলেন—তুমুল গর্জন করে একদিন বিকালে মেঘবারি বর্ষণ করল। জল প্রচুর নয়, তবে সূত্রপাত হিসেবে আশাপ্রদ—কৃষিজীবীরা আনন্দিত হয়ে উঠল—মাঠে এবার লাঙল চলবে।
বেণুকর বলল, ‘যাক বৃষ্টি তো হলো।’
জানকী বলল, ‘এবার আমায় ছেড়ে বলদের আদর হবে।’
বেণুকর বলল, ‘ধ্যেৎ।’
স্বর খানিক তিক্ত করে জানকী বলল, ‘ধ্যেৎ কেন?’
তারপর মনের কথাটা চেপে বলল, ‘কালই মাঠে বেরুতে হবে তো!’
‘হবেই তো।’
‘আগে চষবে কোন মাঠটা?’
চার বছর ধরে স্বামীর সঙ্গে কায়মনোবাক্যে সহযোগিতার ফলে জানকী তাদের সব জমিই চেনো
বেণুকর বলল, ‘পূবের মাঠে তিন কিত্যে এক লাগাও—তাতেই হাত দেবো আগে। দুদিন লাগবে দক্ষিণ দিকটা নামো কাজেই উত্তর থেকে লাঙল দিতে হবে। তবে তাড়াতাড়ি তেমন নেই।’ বলে ক্ষেত্ৰকৰ্ষণের ব্যবস্থা করে বেণুকর আকাশের দিকে চাইল—আকাশে মেঘের আনাগোনা রয়েছে।
পরদিন প্রত্যুষে নয়, সকাল বেলা, রোদ ওঠবার পর গুড় মুড়ি আর জল খেয়ে বেণুকর লাঙল আর বলদ নিয়ে, আর হুঁকো আর কলকে প্রভৃতি নিয়ে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে মাঠের উদ্দেশে বেরুচ্ছে, এমন সময় জানকী পিছু ডাকল বলল, ‘টানাকাঠির বাকসো নিয়েছ?’
বেণুকর ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এঃ, প্রথম দিনটাতেই পিছু ডেকে ফেললি! নিয়েছি।’
জানকী বলল, ‘ঘরের যুবতী বউ পিছু ডাকলে ভালো হয়।’
বেণুকর বলল, ‘ধ্যেৎ।’
‘ধ্যেৎ কেন? তারপর জানকী বলল, ‘কাঠির বাকসো মাটিতে নামিয়ে রেখো না, ভিজে উঠবো’।
বেণুকর বলল, “বেশ।’ বলে বেরিয়ে গেলো।
কিন্তু সেদিন দু-কিতার বেশি জমিতে লাঙল দেওয়া সম্ভব হলো না—রোদের তেজ খুব, আর অতিরিক্ত রোদ সহ্য করে তাড়াতাড়ি করবার দরকারও তেমন নেই।
খেতে বসে বেণুকর বলল, ‘দক্ষিণের খানা বাকি রইল কাল ওটা হলেই ও মাঠটা শেষ হয়।’
পরদিন সকালবেলা বেণুকর আবার মাঠে যাবে কিন্তু তার আগে অর্থাৎ খুব ভোরে জানকীকে শয্যা ত্যাগ করতে দেখা গেলো এবং তারপর আরও দেখা গেলো, ন্যাকড়ার একটা পুঁটুলি আর ধারাল একটা খুরপি নিয়ে সে পুবের মাঠের দিকে ছুটছে…
চাষের কাজে সে অবশ্যই যায়নি—গিয়েছে অন্য কাজে।—
সকালবেলা, সূর্যোদয়ের খানিক পরে, গুড়-মুড়ি আর জল খেয়ে বেণুকর আগের মতো মাঠে লাঙল দিতে এসেছে। রাত্রির গরমের পর গ্রীষ্মের প্রাতঃকাল ভারি স্নিগ্ধ লাগায় বেণুকর সানন্দে লাঙলে বলদ জুড়লা পাচনখানা বাগিয়ে ধরে সে আল ছেড়ে খেতে নামল…