‘আকাশের চন্দ্রের মতো মুখ, নীলপদ্মের মতো চক্ষু, শুভ্ৰ কুন্দকুলের মতো দশনপঙক্তি— গগনে জলে স্থলে হৃদ্য যা-কিছু আছে, তার আকার দিয়ে বিধাতা তাকে নির্মাণ করেছেন।’ এ কবিতাকে কাব্য বলা চলে কি না, সে সংশয় স্বাভাবিক। কিন্তু ওই কবিপ্রসিদ্ধিকেই আশ্রয় করে কালিদাস যখন প্রবাসী যক্ষকে দিয়ে বলিয়েছেন–
শ্যামাস্বঙ্গং চকিতহরিণীপ্রেক্ষণে দৃষ্টিপাতং
গণ্ডচ্ছায়াং শশিনি শিখিনাং বহভারেষু কেশান।
উৎপশ্যামি প্রতনুষু নদীবীচিযু ভ্ৰবিলাসান
হন্তৈকস্মিন কচিদপি ন তে ভীরু সাদৃশ্যমস্তি।
তখন তাতে কাব্যত্ব এল কোথা থেকে? ধ্বনিবাদীরা বলেন, অলংকারগুলি তাদের অলংকারিত্বের সীমা ছাড়িয়ে প্রবাসীর বিরহব্যাথাকে ব্যঞ্জনা করছে বলেই এ কবিতা শ্রেষ্ঠ কাব্য। এর বাচ্য কতকগুলি উপমা, কিন্তু এর ‘ধ্বনি।’ প্রিয়াবিরহীর অন্তর-ব্যথা। এবং সেখানেই এর কাব্যত্ব।
মদনের দেহ ভস্ম হয়েছে, কিন্তু তার প্রভাব সমস্ত বিশ্বময়–এই ভাব নিম্নের কবিতা দুটিতে বলা হয়েছে।
স একস্ট্রীণি জয়তি জগন্তি কুসুমায়ধঃ।
হরতাপি তনুং যস্য শম্ভুনা ন হৃতং বলম।
‘সেই এক কুসুমায়ুধ তিন লোক জয় করে। শম্ভু তার দেহ হরণ করেছেন, কিন্তু বলা হরণ করতে পারেননি।’
কর্পূর ইব দগ্ধোহপি শক্তিমান যে জনে জনে।
নমোহস্তুবার্যবীৰ্যায় তস্মৈ কুসুমধাম্বনে ॥
‘দগ্ধ হলেও কর্পূরের মতো প্ৰতিজনকে তার গুণ জানাচ্ছে, অবার্যবীর্য সেই কুসুমধনু মদনকে নমস্কার।’
অভিনবগুপ্ত বলেছেন। (১।১৩)–এ কবিতা-দুটিতে বাচ্যাতিরিক্ত ব্যঞ্জনা না থাকায় এরা কাব্য নয়। প্রথম কবিতাটি এই ভাবমাত্র প্রকাশ করেই শেষ হয়েছে যে, মদনের শক্তির কারণ অচিন্ত্য–ইয়ং চাচিন্ত্যনিমিত্তেতি নস্যাং ব্যঙ্গ্যস্য সদ্ভাবঃ। দ্বিতীয়টি কর্পরের স্বভাবের সঙ্গে মদনের স্বভাবের তুলনাতেই পৰ্যবসিত হয়েছে— বস্তুস্বভাবমাত্রত্বে পৰ্যবসানমিতি তত্ৰাপি ন ব্যঙ্গ্যসম্ভাবশঙ্কা। কিন্তু ঠিক এই কথাই রবীন্দ্রনাথের ‘মদনভস্মের পর’ কবিতায় কাব্য হয়ে উঠেছে
পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ এ কী সন্ন্যাসী!
বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে।
ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে ওঠে নিশ্বাসি,
অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে।
অভিনবগুপ্ত নিশ্চয় বলতেন, তার কারণ এ কবিতার কথা তার বাচ্যকে ছাড়িয়ে, মানব-মনের যে চিরন্তন বিরহ, যা মিলনের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে, তারই ব্যঞ্জনা করছে। এবং সেইখানেই এর কাব্যত্ব। অভিনবগুপ্ত অবশ্য ঠিক এ ভাষা ব্যবহার করতেন না, কিন্তু ওই একই কথা তিনি তার আলংকারিকের ভাষায় বলতেন যে, এ কবিতার কাব্যত্ব হচ্ছে এর করুণ বিপ্ৰলম্ভের ধ্বনি’।
এই যে তিনটি উদাহরণেই দেখা গেল কাব্যের আত্মা হচ্ছে তার বাচ্য নয়, ‘ব্যঞ্জন’, কথা নয়, ‘ধ্বনি’–এ ব্যঞ্জনা কীসের ব্যঞ্জনা, এ ধ্বনি কীসের ধ্বনি? ধ্বনিবাদীদের উত্তর‘রস’-এর। তাঁরা দেখিয়েছেন, বাক্য যদি মাত্র কেবল বস্তু বা অলংকারের ব্যঞ্জনা করে, তবে তা কাব্য হয় না। রােসর ব্যঞ্জনাই বাক্যকে কাব্য করে। কাব্যের ‘ধ্বনি’ হচ্ছে রসের ধ্বনি। তিনটি উদাহরণেই কবিতার বাচ্য রসের ব্যঞ্জনা করছে বলেই তা কাব্য। এই রসের যোগেই পরিচিত সাধারণ কথা নবীনত্ব লাভ করে কাব্যে পরিণত হয়েছে।
দৃষ্টপূর্ব অপি হ্যর্থঃ কাব্যে রসপরিগ্রহাৎ।
সর্বে নবা ইবাভান্তি মধুমাস ইব দ্রুমাঃ।’
‘পূর্বপরিচিত অর্থও রসের যোগে কাব্যত্ব লাভ করে বসন্তের নবকিশলয়খচিত বৃক্ষের মতো নূতন বলে প্রতীয়মান হয়।’ অর্থাৎ কাব্যের আত্মা ‘ধ্বনি’ বলে যাঁরা আরম্ভ করেছেন, কাব্যের আত্মা ‘রস’ বলে তাঁরা উপসংহার করেছেন। বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম।’ কাব্য হচ্ছে সেই বাক্য, ‘রস’ যার আত্মা।
কোহয়ং রসঃ। এ রস’ জিনিসটি আবার কী?
পাঠকেরা যদি ইতিমধ্যেই নিতান্ত বিরস না হয়ে থাকেন, তবে পরের প্রস্তাবে প্ৰাচীন আলংকারিকদের রসবিচারের পরিচয় পাবেন। লেখকের মতে কাব্য সম্বন্ধে তার চেয়ে খাঁটি কথা কোনও দেশে, কোনও কালে, আর কেউ বলেনি।