অত্ৰ মৃগাঙ্গনাবলোকনেন তদবিলোকনসোপমা যদ্যপি ব্যঙ্গা, তথাপি
বাচ্যস্য সা সন্দেহলাংকারস্যভুত্থানকারিণীত্বেনানুগ্রহকত্বাব্দ গুণীভুত।
অনুগ্রাহ্যুত্বে তহিঁ সন্দেহে পৰ্যবসানম।’
অর্থাৎ, অভিনবগুপ্তের মতে মহাকবির এই বিখ্যাত কবিতাটি শ্রেষ্ঠ কাব্য নয়, বর্ণনাকৌশলে মনোহারী মাত্র।
সমাসোক্তি ও সংকরালংকারে যে ব্যঞ্জনা থাকে, সে ব্যঞ্জনা যে কাব্যের আত্মা ‘ধ্বনি’’ নয়, এ বিচারের উদ্দেশ্য এই প্ৰমাণ করা যে, বাক্যে যে-কোনও ব্যঞ্জনা থাকলেই তা কাব্য হয়। না। বিশ্বনাথ অবশ্য সােজাসুজি বলেছেন, তা হলে প্ৰহেলিকাও কাব্য হত। কিন্তু এই সব অলংকার প্রযুক্ত হলে, তাদের কৌশল ও মাধুর্য তাদের ব্যঞ্জনাকে ‘ধ্বনি’ বলে ভ্ৰম জন্মাতে পারে, এইজন্য এদের সম্বন্ধেই বিশেষ করে সাবধান করা প্রয়োজন। সমাসোক্তিতে যে ব্যঞ্জনা, তা হচ্ছে এক বস্তুর বর্ণনা দিয়ে অন্য বস্তুর ব্যঞ্জনা। সংকরালংকারের ব্যঞ্জনা এক অলংকার দিয়ে অন্য অলংকারের ব্যঞ্জনা। সুতরাং যেখানে শব্দার্থ কেবলমাত্র বস্তু বা অলংকারের ব্যঞ্জনা করে, সে ব্যঞ্জনা শ্রেষ্ঠ কাব্যের ‘ধ্বনি’ বা ব্যঞ্জনা নয়। যে ‘ধ্বনি’ কাব্যের আত্মা, তার ব্যঞ্জনা কাব্যের বাচার্থকে বস্তু ও অলংকারের অতীত এক ভিন্ন লোকে পৌঁছে দেয়।
কাব্য তার বাচ্যাৰ্থকে ছাড়িয়ে যায়, মহাকবির কথা কথার অতীত লোকে পাঠককে নিয়ে যায়—-এ-সব উক্তি যেমন একালের, তেমনি সেকালের বস্তুতান্ত্রিক লোকের কাছে হেঁয়ালি বলেই মনে হয়েছে। প্রাচীন বস্তুতান্ত্রিকেরা বলেছেন– কাব্যের বাচ্যও নয়, তার গুণ-অলংকারও নয়, অথচ ‘ধ্বনি’ বলে অপূর্ব এক বস্তু, এ আবার কী। ও-জিনিস হয় কাব্যের শোভা, তার গুণ ও অলংকারের মধ্যেই আছে, নয়তো ও কিছুই নয়, একটা প্রবাদ মাত্ৰ; খুব সম্ভব শব্দ ও অর্থের অনন্ত বৈচিত্র্যের মধ্যে প্ৰসিদ্ধ। আলংকারিকেরা বর্ণনা করেননি এমন একটি বৈচিত্র্যাকে একজন বলেছে ‘ধ্বনি’, আর আমনি একদল লোক অলীক সহৃদয়ত্বভাবনায় মুকুলিতচক্ষু হয়ে ‘ধ্বনি’ ‘ধ্বনি’ বলে নৃত্য আরম্ভ করেছে—
কিং চ বাগবিকল্পনামানন্ত্যাৎ সংভবত্যপি বা কস্মিংশ্চিৎ কাব্যলক্ষণ-বিধায়িভিঃ প্ৰসিদ্ধৈর প্রদর্শিতে প্রকারলেশে ধ্বনিধৰ্বনিরিতি তদলীক সহৃদয়ত্বভাবনা মুকুলিতলোচনৈৰ্ম্মত্যতে। তস্মাৎ প্ৰবাদমাত্ৰং ধ্বনিঃ।।
ধ্বনিবাদের মুখ্যাচাৰ্য আনন্দবর্ধন তার ধ্বন্যালোক গ্রন্থে মনোরথ নামে এক সমসাময়িক কবির বাক্য তুলেছেন, যা নিশ্চয়ই একালের বস্তুতান্ত্রিকদের মনোরথ পূর্ণ করবে–
যস্মিন্নাস্তি ন বস্তু কিঞ্চন মনঃপ্রত্নাদি সালংকৃতি
বুৎপন্নৈ রচিতং চ নৈব বচনৈর্বাক্রোক্তিশূন্যং চ যৎ।
কাব্যং তদ ধ্বনিনা সমন্বিতমিতি প্রীত্যা প্রশংসন জড়ো
নো বিদ্মোহভিদধাতি কিং সুমতিনা পৃষ্টঃ স্বরূপং ধ্বনেঃ ॥
‘যে কবিতায় সুষমাময় মনোরম বস্তু কিছু নেই, চতুর বচনবিন্যাসে যা রচিত নয় এবং অর্থ যার অলংকারহীন, জড়বুদ্ধি লোকেরা গতানুগতিকের গ্ৰীতিতে (অর্থাৎ ফ্যাশানের খাতিরে) তাকেই ধ্বনিযুক্ত কাব্য বলে প্রশংসা করে। কিন্তু বুদ্ধিমান লোকের কাছে ‘ধ্বনি’র স্বরূপ কেউ ব্যাখ্যা করেছে, এ তো জানা যায় না।’
এ সমালোচনায় ধ্বনিবাদীরা বিচলিত হননি। তাঁরা স্বীকার করেছেন কাব্যের ‘ধ্বনি’, তার বাচ্যার্থের মতো এত স্পষ্ট জিনিস নয় যে, ব্যাকরণ ও অভিধানে বুৎপত্তি থাকলেই তার প্রতীতি হবে। কিন্তু তাঁরা বলেছেন, যার কিছুমাত্র কাব্যবোধ আছে, তাকেই হাতেকলমে প্রমাণ করে দেখানো যায় যে, কাব্যের আত্মা হচ্ছে ‘ধ্বনি’, বাচ্যাতিরিক্ত এক বিশেষ বস্তুর ব্যঞ্জনা। কারণ, বাচ্য বা বক্তব্য এক হলেও এই ‘ধ্বনির অভাবে এক বাক্য কাব্য নয়, আর ‘ধ্বনি’ আছে বলে অন্য বাক্য শ্রেষ্ঠ কাব্য, এ সহজেই দেখানো যায়। ধ্বনিবাদীদের অনুসরণে দু’-একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
‘বিবাহ প্রসঙ্গে বরের কথায় কুমারীরা লজ্জানতমুখী হলেও পুলকোদগমে তাদের অন্তরের স্পাহা সূচিত হয়–এই তথ্যটি নিম্নের শ্লোকে বলা হয়েছে—
কৃতে বরকথালাপে কুমাৰ্যঃ পুলকোদগমৈঃ।
সূচয়ন্তি স্পাহামন্তর্লজ্জয়াবনতাননাঃ ॥
কোনও কাব্যরসিক এ শ্লোককে কাব্য বলবে না। ঠিক ওই কথাই কালিদাস পাৰ্বতীর সম্বন্ধে কুমারসম্ভবে বলেছেন, যেখানে নারদ মহাদেবের সঙ্গে বিবাহ প্ৰস্তাব নিয়ে হিমালয়ের কাছে এসেছেন–
এবংবাদিনি দেবর্ষৌ পার্শ্বে পিতুরধোমুখী।
লীলাকমলপত্ৰাণি গণিয়ামাস পার্বতী।
এর কাব্যত্ব সম্বন্ধে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। কিন্তু কেন? কোথায় এর কাব্যত্ব? এর যা বাচার্থ, তা তো পূর্বের শ্লোকের সঙ্গে এক। কোনও অলংকারের সুষমায় এ কাব্য নয়; কারণ কোনও অলংকারই এতে নেই। ধ্বনিবাদীরা বলেন, স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, এ কবিতার শব্দার্থ, লীলাকমলের পত্রগণনা— তার বাচার্থ ছাড়িয়ে অর্থান্তরের–পূর্বরাগের লজ্জাকে ব্যঞ্জনা করছে; এবং সেইখানেই এর কাব্যত্ব।
অত্র হি লীলাকমলপত্রগণনমুপসর্জনীকৃতস্বরূপং.. অৰ্থান্তরং ব্যভিচারিভাবলক্ষণং প্ৰকাশয়তি।
নারীর সৌন্দর্যের উপমান যে জল স্থল আকাশের সর্বত্র খুঁজতে হয়, এ একটি অতিসাধারণ কবিপ্ৰসিদ্ধি। নিম্নের শ্লোকে সেই ভাবটি প্রকাশ করা হয়েছে।
শশিবদনাসিতসরসিজনয়না সিতকুন্দদশনপংক্তিরিয়ম।
গগনজলস্থলসংভবহৃদ্যাকারা কৃতা বিধিনা।