অলংকারবাদকে একটু শুধরে নিয়ে আর-এক দল আলংকারিক বলেন, অলংকৃত বাক্য মাত্রেই যে কাব্য নয়, আর নিরলংকার বাক্যও কাব্য হতে পারে, তার কারণ কাব্যের আত্মা হচ্ছে ‘রাতি’। রীতিরাত্মা কাব্যস্য। ‘রীতি’ হল পদরচনার বিশিষ্ট ভঙ্গি। বিশিষ্ট পদরচনা রীতিঃ।’ অর্থাৎ কাব্যের আত্মা হল ‘সটাইল’। স্টাইলের গুণেই বাক্য বা সন্দর্ভ কাব্য হয়, আর তার অভাবে বক্তব্য বিষয়ের সমতা থাকলেও অন্য বাক্য কাব্য হয় না। স্বীকার করতে হবে, পৃথিবীর অনেক কবির কাব্য এই গুণেই লোকরঞ্জক হয়েছে। ভারতচন্দ্রের প্রধান আকর্ষণ তাঁর স্টাইল। ইউরোপের অনেক আধুনিক পদ্য ও গদ্য-লেখক এই স্টাইলের গুণে বা নবীনত্বে আর্টিস্ট বা কবি নাম পেয়েছেন। অলংকার হচ্ছে এই স্টাইল বা রীতির আনুষঙ্গিক বস্তু। অঙ্গে অলংকার পরলেই মানুষকে সুন্দর দেখায় না, যদি না তার অবয়বসংস্থান নির্দোষ হয়। স্টাইল হচ্ছে কাব্যের সেই অবয়বসংস্থান।
রীতিবাদের দোষ দেখিয়ে অন্য আলংকারিকেরা বলেন, নির্দোষ অবয়বে ভূষণ যোগ করলেই সৌন্দৰ্য আসে না, শরীরেও নয় কাব্যেও নয়।
প্রতীয়মানং পুনরন্যদেব বস্ত্বস্তি বাণীষু মহাকবীনাম্।
যত্তৎপ্ৰসিদ্ধাবয়বাতিবিক্তং বিভাতি লাবণ্যমিবাঙ্গনাসু ॥
‘রমণীদেহের লাবণ্য যেমন অবয়বসংস্থানের অতিরিক্ত অন্য জিনিস, তেমনি মহাকবিদের বাণীতে এমন বস্তু আছে যা শব্দ, অর্থ, রচনাভঙ্গি, এ সবার অতিরিক্ত আরও কিছু।’ এই ‘অতিরিক্তবস্তুই কাব্যের আত্মা।
এ বিস্তু’ কী। উত্তরে বস্তুবাদী আলংকারিকেরা বলেন, এ জিনিসটি হচ্ছে কাব্যের বাচ্য বা বক্তব্য। ‘তরঙ্গনিক রোমীত’ ইত্যাদি যে কাব্য নয়। তার কারণ, ওর বাচ্য কিছুই নয়, ওর বক্তব্য বিষয় অকিঞ্চিৎকর। অন্য বাক্যের মতো কাব্যও পদসমুচ্চয় দিয়ে, শব্দের সঙ্গে শব্দ সাজিয়ে, কোনও বস্তু বা ভাবকে প্ৰকাশ করে। কাব্যের কাব্যত্ব নির্ভর করে ওই বস্তু বা ভাবের বিশিষ্টতার উপর। সব বস্তু কি সব ভাব কাব্যের বিষয় নয়। বিশেষ বিশেষ প্রকারের বস্তু ও বিশেষ বিশেষ রকমের ভাবকে প্রকাশ করলেই তবে বাক্য কাব্য হয়। যেমন, ভাব কি বস্তুর মনোহারিত্ন, চমৎকারিত্ব বা অভিনবত্ব বাক্যকে কাব্য করে। অনেক বস্তু আছে যা স্বভাবতই মনোহারী–চন্দ্ৰচন্দনকোকিলালাপভ্রমরাঝংকারাদয়ঃ। অনেক ভাব, যেমন–প্ৰেম, করুণা, বীর্য, মহত্ত্ব, মনকে সহজেই আকৃষ্ট করে। কবিরা এইসব বিশিষ্ট ভাব ও বস্তুকে কাব্যে প্রকাশ করেন; এবং তাদের বিশিষ্ট পদরচনাভঙ্গি, শব্দ ও অর্থে যথোচিত অলংকারের সমাবেশ, তাদের বাচ্য ভাব ও বস্তুকে অধিকতর মনোজ্ঞ করে তোলে। ভাব, বস্তু, রীতি ও অলংকার, এদের যথাযথ সমবায়েই কাব্যের সৃষ্টি। এ-সবার অতিরিক্ত কাব্যের আত্মা বলে আর ধর্মান্তর নেই। যেমন বাৰ্হস্পত্যেরা বলেছেন–রক্ত, মাংস, মজ্জা ইত্যাদি উপাদানের সংমিশ্রণেই মানবদেহে চেতনার আবির্ভাব হয়; মন নামে কোনও স্বতন্ত্র বস্তু নেই।
যে-সব আলংকারিক বস্তুবাদীদের মতে মত দিতে পারেননি, তাদেরও স্বীকার করতে হয়েছে, অধিকাংশ কবির কাব্য এই ভাব, বস্তু, রীতি ও অলংকারের গুণেই কাব্য। এমনকী, মহাকবিদের কাব্যপ্রবন্ধেরও অনেকাংশে এ ছাড়া আর কিছু নেই। তবে তাদের ভাব ও বস্তুর চমৎকারিত্ব হয়তো বেশি, তাদের রচনা ও প্রকাশভঙ্গি আরও বিচিত্র, তাদের অলংকার অধিকতর সংগত ও শোভন। কিন্তু তবুও যে এই আলংকারিকেরা কাব্যবিচারে এখানেই থামতে পারেননি, তার কারণ, তাঁরা দেখেছেন, যা শ্রেষ্ঠ কাব্য তার প্রকৃতিই হচ্ছে বাচাকে ছাড়িয়ে যাওয়া। শব্দার্থমাত্রে যেটুকু প্ৰকাশ হয়, সেই কথাবস্তু কাব্যের প্রধান কথা নয়। তা যদি হত, তবে যার শব্দার্থের জ্ঞান আছে, তারই কাব্যের আস্বাদন হত, কিন্তু তা হয় না।
শকদার্থশাসন জ্ঞানমাত্ৰেণৈব ন বেদ্যতে।
বেদ্যতে সাহি কাব্যার্থতত্ত্বজ্ঞৈরেব কেবলম।।
‘কাব্যের যা সার অর্থ, কেবল শব্দার্থের জ্ঞানে তার জ্ঞান হয় না, একমাত্র কাব্যার্থতত্ত্বজ্ঞেরাই সে অর্থ জানতে পারেন।’
যদি চ বাচ্যরূপ এবাসাব্যৰ্থঃ স্যাৎ তদ্বাচ্য-বাচক-স্বরূপপরিজ্ঞানাদেব তৎপ্রতীতিঃ স্যাৎ।
‘কাব্যার্থ যদি কেবল বাচ্যরূপ হত, তবে বাচ্যবাচকের স্বরূপজ্ঞানেই কাব্যার্থের প্রতীতি হত।’
অথচ বাচ্যবাচকরুত্বপলক্ষণকৃতশ্রমাণাং কাব্যতত্ত্বার্থভাবনাবিমুখীনাং
স্বরাশ্রত্যাদি লক্ষণমিবাপ্ৰগীতানাং গান্ধৰ্বলক্ষণবিদ্যামগোচর এবাসাব্যৰ্থঃ।
‘অথচ দেখা যায়, কেবল বাচ্যবাচক-লক্ষণের জ্ঞানলাভেই যাঁরা শ্ৰম করেছে, কিন্তু বাচ্যাতিরিক্ত কাব্যতত্ত্বের আস্বাদনে বিমুখ, প্রকৃত কাব্যার্থ তাদের অগোচর থাকে; যেমন গানের লক্ষণমাত্র যাঁরা জানে তাদেরই সংগীতের সুর ও শ্রুতির অনুভূতি হয় না।’ অর্থাৎ শ্ৰেষ্ঠ কাব্য নিজের বাচ্যার্থে পরিসমাপ্ত না হয়ে বিষয়াস্তরের ব্যঞ্জনা করে। আলংকারিকেরা কাব্যের এই বাচ্যাতিরিক্ত ধৰ্মান্তরের অভিব্যঞ্জনার নাম দিয়েছেন ‘ধ্বনি’।
যত্ৰাৰ্থঃ শব্দো বা তমৰ্থমুপসর্জনীকৃতস্বার্থৌ।
ব্যঙুক্তঃ কাব্যবিশেষঃ স ধ্বনিরিতি সুরিভিঃ কথিতঃ ॥
‘যেখানে, কাব্যের অর্থ ও শব্দ নিজেদের প্রাধান্য পরিত্যাগ করে ব্যঞ্জিত অৰ্থকে প্রকাশ করে, পণ্ডিতেরা তাকেই ‘ধ্বনি’ বলেছেন।’ এই ব্যঞ্জিত অর্থের আলংকারিক পরিভাষা হল ‘ব্যঙ্গ্য’ বা ‘ব্যঙ্গ্যার্থ’। ধ্বনিবাদীরা বলেন, এই ধ্বনি বা ‘ব্যঙ্গ্য’ হচ্ছে কাব্যের আত্মা, তার সারতাম বস্তু।