- বইয়ের নামঃ কাব্যজিজ্ঞাসা
- লেখকের নামঃ অতুলচন্দ্র গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
ধ্বনি
ইহুদি ও খ্রিস্টানের ধর্মপুথিতে বলে, বিধাতাপুরুষ তাঁর আকাঙ্ক্ষার বলে দেীঃ পৃথিবী, আলো অন্ধকার, সূৰ্য চন্দ্র সব সৃষ্টি করলেন, এবং সৃষ্টির পর দেখলেন যে সে-সৃষ্টি অতি চমৎকার। ওই পুরাণেই বলে, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে তৈরি করেছেন তার প্রতিরূপ করে, আর নিজের নিশ্বাসবায়ুতে তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। অর্থাৎ, মানুষ যেখানে স্ৰষ্টা তার সৃষ্টির রহস্য বিশ্বসৃষ্টিরহস্যেরই প্রতিচ্ছায়া; অথবা, যা একই কথা, নিজের সৃষ্টির স্বরূপ ছাড়া সৃষ্টিতত্ত্ব-আয়ত্তের আর কোনও চাবি মানুষের হাতে নেই। বাইবেলের বিধাতার মতো মানুষ অন্তরাত্মার আকাঙ্ক্ষার চালনায় যা সৃষ্টি করে তার চমৎকারিত্ব তার নিজেকেই বিস্মিত করে দেয়। বাহিরের বিশ্বের স্বরূপ ও সৃষ্টিকৌশল আবিষ্কারে যেমন মানুষের বুদ্ধির বিরাম নেই, নিজের সৃষ্টির স্বরূপ ও কৌশলের জ্ঞানেও তার ঔৎসুক্যের সীমা নেই। কেননা সে-সৃষ্টিও মানুষের বুদ্ধির কাছে বাইরের বিশ্বের মতোই রহস্যময়।
‘রামায়ণে’ কাব্যের জন্মকথার যে কাব্যেতিহাস আছে, তাতে মানুষের সৃষ্টির এই তত্ত্বই কাব্যসৃষ্টি সম্বন্ধে বলা হয়েছে। ক্ৰৌঞ্চদ্বন্দ্ব-বিয়োগের শোকে যখন বাল্মীকির মুখ থেকে ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং’ ইত্যাদি বাক্য আপনি উৎসারিত হল তখন–
তস্যেত্থং ব্রুবতশ্চিন্তা বভূব হৃদি বীক্ষতঃ।
শোকার্তেনাস্য শকুনেঃ কিমিদং ব্যাহৃতং ময়া।।
‘বীক্ষণশীল মুনির হৃদয়ে চিন্তার উদয় হল, শকুনির শোকে শোকার্ত হয়ে এই যে আমি উচ্চারণ করলেম।—এ কী!’ তখন নিজের প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি এর প্রকৃতি চিন্তা করতে লাগলেন–
চিন্তয়ন্ স মহাপ্রাজ্ঞশ্চকার মতিমান্ মতিম্!
এবং শিষ্যকে বললেন—
পাদবদ্ধোহস্ৰক্ষরসমস্তন্ত্রীলয়সমন্বিতঃ। শোকার্তস্য প্রবৃত্তো মে শ্লোকো ভবতু নান্যথা ॥
‘এই বাক্য পাদবদ্ধ, এর প্রতি পদে সমাক্ষর, ছন্দের তন্ত্রীলিয়ে এ আন্দোলিত; আমি শোকার্ত হয়ে একে উচ্চারণ করেছি, এর নাম শ্লোক হোক।’
রামায়ণকার আদিকবির মুখ দিয়ে যে কৌতুহল প্রকাশ করেছেন, সেটি কাব্যরসিক মানবমনের সাধারণ কৌতুহল। মহাকবিদের প্রতিভা এই-যে অপূর্ব মনোহর শব্দগ্ৰস্থনের সৃষ্টি করে, ‘কিমিদম্’–এ কী বস্তু। এর স্বরূপ কী। তার উত্তরে যে আলোচনার উৎপত্তি, আমাদের দেশের প্রাচীনেরা তার নাম দিয়েছেন অলংকারশাস্ত্ৰ। সে শাস্ত্রের প্রধান কথা কাব্যজিজ্ঞাসা। কাব্যের কাব্যত্ব কোথায়। কোন গুণে বাক্য ও সন্দর্ভ। কাব্য হয়। আলংকারিকদের ভাষায়, কাব্যের আত্মা কী।
কাব্যের আত্মা যা-ই হোক, ওর শরীর হচ্ছে বাক্য–অর্থযুক্ত পদসমুচ্চয়। সুতরাং কাব্যদর্শনে যাঁরা দেহাত্মবাদী, তাবা বলেন, ওই বাক্য অর্থাৎ শব্দ ও অর্থ ছাড়া কাব্যের আর স্বতন্ত্র আত্মা নেই। বাক্যের শব্দ আর অর্থকে আটপৌরে না রেখে সাজসজ্জায় সাজিয়ে দিলেই বাক্য কাব্য হয়ে ওঠে। এই সাজসজ্জার নাম অলংকার। শব্দকে অলংকারে, যেমন অনুপ্ৰাসে, সাজিয়ে সুন্দর করা যায়, অর্থকে উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা নানা অলংকারে চারুত্ব দান করা যায়। কাব্য যে মানুষের উপাদেয়, সে এই অলংকারের জন্য। কাব্যং গ্রাহ্যামলংকারাৎ।৷ ‘ এ মতকে বালকোচিত বলে উড়িয়ে দেওয়া কিছু নয়। এই মত থেকেই কাব্যজিজ্ঞাসা শাস্ত্রের নাম হয়েছে অলংকারশাস্ত্র। এবং যেমন অধিকাংশ লোক মতে না হলেও জীবনে লোকায়ত মতের অনুবতী, দেহ ছাড়া যে মানুষের আর কিছু আছে তাদের জীবনযাত্ৰা তার কোনও প্রমাণ দেয় না, তেমনি, মুখের মতামত ছেড়ে যদি অন্তরের কথা ধরা যায়, তবে দেখা যাবে অধিকাংশ কাব্যপাঠক কাব্যবিচারে এই দেহাত্মবাদী। তাদেব কাব্যের আস্বাদন শব্দ ও অর্থের অলংকারের আস্বাদন এবং সেইজন্য অনেক লেখক, যাদের রচনা অলংকৃত বাক্য ছাড়া আর-কিছু নয়, তাঁরা পৃথিবীর সব দেশে কবি পদবি লাভ করেছে।
অলংকারবাদীদের সমালোচনায় অন্য আলংকারিকেরা বলেছেন, কাব্য যে অলংকৃত বাক্য নয়। তার প্রমাণ, শব্দ ও অর্থ দু-রকম অলংকারই আছে অথচ বাক্যটি কাব্য নয়, এর বহু উদাহরণ দেওয়া যায়; আবার সর্বসম্মতিতে যা অতি শ্রেষ্ঠ কাব্য, তার কোনও অলংকার নেই, এরও উদাহরণ আছে। অর্থাৎ সমালোচকদের ন্যায়ের ভাষায় কাব্যোব ও-সংজ্ঞাটি অতিব্যাপ্তি ও অব্যাপ্তি দুই দোষেই দুষ্ট। যেমন ‘সাহিত্যদৰ্পণ’-এর একজন টীকাকার উদাহরণ দিয়েছেন–
তরঙ্গনিকরোন্নীততরুণীগণসংকুলা।
সরিদ্ বহতি কল্লোলব্যুহব্যাহতভীবভুঃ ॥
এ বাক্যের শব্দে ও অর্থে অনুপ্রাস ও রূপক অলংকার রয়েছে, কিন্তু একে কেউ কাব্য বলবে না। বাক্য অনলংকৃত অথচ শ্রেষ্ঠ কাব্য, এর উদাহরণে সাহিত্যদর্পণকার কুমারসম্ভবের অকালবসন্ত-বর্ণনা থেকে তুলেছেন–
মধু দ্বিরেফঃ কুসুমৈকপাত্ৰে পপেী প্রিয়াং স্বামনুবর্তমানঃ।
শৃঙ্গেণ চ স্পর্শনিমীলিতাক্ষীং মৃগীমকণ্ডুয়ত কৃষ্ণসাবঃ ॥
এর এখানে-ওখানে যে একটু অনুপ্রাসের আমেজ আছে, তরঙ্গ-নিকর্যোয়ীত-তরুণীগণের কাছে তা দাড়াতেই পারে না, আর এর অর্থ একেবারে নিরলংকার। অকালবসন্তের উদ্দীপনায় যৌবনরাগে রক্ত বনস্থলীতে রতিদ্বিতীয় মদনের সমাগমে তির্যকপ্ৰাণীদের অনুরাগের লীলাটি মাত্র কালিদাস ভাষায় প্রকাশ করেছেন। তাকে কোনও অলংকারে সাজাননি। অথচ মনোহারিত্বে পাঠকের মনকে এ লুঠ করে নেয়। অলংকারবাদীরা বলবেন, এখানেও অলংকার রয়েছে–যার নাম স্বভাবোক্তি অলংকার। প্রতিপক্ষ উত্তরে বলবেন, ওই নামেই প্ৰমাণ–অলংকার ছাড়াও কাব্য হয়। কারণ, যেখানে ক্রিয়া ও রূপের অকৃত্রিম বর্ণনাই কাব্য, সেখানে নেহাত মতের খাতিরে ছাড়া সেই বর্ণনাকেই আবার অলংকার বলা চলে না।