পূর্ববঙ্গে ‘মইষাল বন্ধুর গান’ বহু আছে। সেগুলি ‘ছুটাগান’, এই পালার গান নহে। এই পালাটির রচইতা কবির নাম পাওয়া যা না। পালাটি বোধ হয় প্রাক মুসলিম যুগের কাহিনী অবলম্বনে রচিত।
শ্রীক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
আগমেশ্বরী পাড়া রোড,
নবদ্বীপ
মাঘ ১৩৭৬
———–
মইষাল বন্ধু-সাঁজুতী কন্যার পালা
(১)
চলে নদী শিঙ্গাখালি সুতে খরষাণ।
যার জলে আশ্বিন মাসে খাইছে বাঁকের ধান।।
সুজন গিরস্থ তথায় বসত যে করে।
তার কথা সভাজন শুন সুবিস্তারে।।
তের আড়া ভুইয়ের মধ্যে মইষে বায় হাল।
গোলাতে ভরিয়া তুলে ধরু ধান চাল।।
এক পুওর আছে তার পূন্নু মাসীর চান্দ।
বাপ-মাও রাইখ্যাছে তার ডিঙ্গাধর নাম।।
দশনা বচ্ছরের পুত্র হাইস্যা খেলায় পাড়া।
এমন কালে মরুল মাও দুখু হইল বাড়া।।
একে একে তার ঘরের লক্ষী গেল ছাড়ি।
আগুন লাইগা পুইড়া গেল তিন খণ্ড বাড়ী।।
আরে ভাইরে বিধির কিবা কাম।
কপাল যইখন ভাঙ্গে রে ভাই পাথরে হয় ঘাম॥+
বাতানে মইষ মইল পালে মরল গাই।
বিপদ কালে রাখে তারে এমন বান্ধব নাই।।
আইশ্না পানিতে খাইল ক্ষেতের পাকা ধান।
নদীর বাঁকের ধান খাইল সুতে খরষাণ॥+
যেইনা দিগে ছাইয়া দেখে কিছু নাইত পায়।+
কেমন কইরা বাড়ীঘর গিরস্থী বাচায় ৷৷+
গরু নাই মইষ নাই নাই বীজ ধান।+
দুঃখের দরদী নাই করিতে আসান।।
কানাকড়ার সম্বল নাই ভাবে মনে মনে।
কি দিয়া বাইব হাল মাঠের জমিনে।।
পোষ মাসের পোষা শীত গায়ে বস্তর নাই।+
দেয়ানের তাগিদদার খাজনা তার চাই।।+
ঘরে যা আছিল সব বেইচ্যা খাজনা দিল।+
কলার পাত পাইতা দোয়ে খুদের জাউ খাইল॥+
ভাবিয়া চিন্তিয়া সুজন কোন কাম করে।
গিষ্ঠেতে বান্ধিয়া চিড়া যায় শিঙ্গাপুরে।।
শিঙ্গাপুরের বলরাম ধনী মহাজন।
ধনের লাগিয়া তার নাই অনাটন।।
ধারে সুদে কত লোক ট্যাকা লইয়া যায়।
সেই সুদে বলরাম সংসার চালায়।।
বারো মাসে তের পার্বণ মণ্ডলের রাজা।
আশ্বিন মাসে বলরাম করে দুর্গা পূজা।।
কাত্তিক মাসে কাত্তিক পূজা করে জাকাইয়া।
আগণ মাসে লক্ষীপূজা নয়া ধান দিয়া।।
তার বাড়ী গেল সুজন ধারের লাগিয়া।+
কইতে লাগিল তারে কাতর হইয়া।।+
দয়া যদি কর পরভু কিরপা যদি কর।
গণিয়া দিবা সুদ দেও কিছু ধার।।
সোনার জমিন পইড়া রইছে হাল গরু নাই।
পইড়্যাছে দুঃখের দিন কিছু ট্যাকা চাই।।
একশ ট্যাকা কর্জ কৈল কইরা লেখাপড়া।
বাড়ীতে ফিরিল সুজন হইয়া গোয়াড়া।।
আগুনে পুড়িয়া গেছে বান্ধে নয়া ঘর।
হালের মৈষ কিন্যা লইল হরিষ অন্তর।।
জমিনে বাইয়া হাল বুনন, কল ধান।
চৈত মাসে দিল সুজন জমিনে নিড়ান।।
বৈশাক জষ্টি দুই মাস গেল এই মতে।
আষাঢ় মাসে পাকা ধান লাগিল কাটিতে।।
কার ধান কেবা কাটে সুজন মৈল জ্বরে।
ক্ষেতের ধান ক্ষেতে রইল এইত প্রকারে।।
আশা কইরা করে কাম নৈরাশে ডুবায়।
কার ধান জমিন বাড়ী কুথায় রাইখা যায়।।
[১। সুতে = স্রোত। ২। খরষাণ = ক্ষুরধার, তীব্ৰবেগ। ৩। বাঁকের = নদীর বক্র স্থানের। ৪। গিরস্থ=কৃষক। ৫। আড়া=চার বা ছয় বিঘায় এক আড়া। ৬। ষরু = সরিষা প্রভৃতি শীতের ফসল। ৭। পূন্ন মাসীর -পূর্ণিমার। ৮। বাড়া = বড়ো বেশী। ৯। তিনখণ্ড বাড়ী = প্রথম খণ্ডে গোশালা, দ্বিতীয়খণ্ডে শয়ন গৃহ গোলা প্রভৃতি, তৃতীয় খণ্ডে রন্ধনশালা অন্দরমহল। ১০। পাখর=পাথর। ১১। ঘাম=ঘর্ম। ১২। মইল = মরিল। ১৩। আসান – সান্ত্বনা। ১৪। দোয়ে দুইজনে। ১৫। গিষ্ঠেতে=পরিধান বস্ত্রের এক প্রান্তে। ১৬। অনাটন = অনটন, অভাব। ১৭। জাকাইয়া – জাঁক জমক্ করিয়া। ১৮। ধারের = কর্জের। ১৯। পভু= প্রভু। ২০। গোয়াড় = দৃঢ়সঙ্কল্প, (গোয়ার শব্দের অপভ্রংশ, সেন মহাশয়ের মতে-প্রফুল্ল।)।
পাঠান্তর :-
আইশনা পাণিতে তার খাইল বাঁকের ধান।
কি দিয়া বাইব হাল বাঁকের জমিনে।।
ভাবিয়া চিন্তিয়া সাধু কোন কাম করে।]
(২)
কান্দে পুত্র ডিঙ্গাধর–আগে মৈল মাও।
অয়রাণে ফেলিয়া বাপ কুথায় চইলা যাও।।
তুমি ছাড়া এই সংসারে আর লক্ষ্য নাই।
আছে গেরামে কেউ জ্ঞিয়াতি বন্ধু ভাই।।
কান্দে বালক ডিঙ্গাধর কইরা হায় হায়।
পাড়া পতিবাসী আইসা ছাওয়ালে বুঝায়।।
বাপ-মাও লয়্যা কেউ জন্ম ভইরা নাই ত থাকে।
ডিঙ্গাধর কান্দে বিধি ফেলিল বিপাকে।।
জ্ঞিয়াতি নাই বন্ধু নাই মায়ের পেটের ভাই।
অকূলে ভাইছি অখন কার বাড়ী যাই।।
হালের মইষ বেইচা বাপের শেষ কাম করে।
তিন বচ্ছর ডিঙ্গাধর কাটাইল ঘরে।।
বাপে ত কইরাছে ঋণ পুত্র নাই সে জানে।
বলরাম আইসা বাড়ী জানায় এক দিনে।।
সুজন ধার্মিক বড় ছিল তোমার বাপ।
অকালে মরিয়া গেল পাইলাম বড়ো তাপ।।
একশ ট্যাকা কর্জ করে বিপাকে পড়িয়া।
পরমাণ করিল কর্জ খত দেখাইয়া।।
গাও-গেরামের লোক তার খতে সাক্ষী আছে।
দিবা কি না দিবা ট্যাকা বলরাম পুছে।।
আশমান ভাঙ্গিয়া পড়ে ডিঙ্গাধরের শিরে।
দুই মাস সময় চায় মাহাজনের পায় ধরে।।
হায় ভালা–
কান্দে পুত্র ডিঙ্গাধর না দেইখা উপায়।
কিমতে বাপের দেনা সুজন সে যায়।।
ধার রাইখা মইরাছে বাপ না হইব গতি।
ঋণের পাপেতে তার নরকে বসতি।।
গাছ হইয়া জন্মিলে ঋণ লতা হইয়া বেড়ে।
ঋণ পাপে মুক্তি নাই জন্ম-জন্মান্তরে।।
গরু হইয়া খাইট্যা সুজে মহাজনের ধার।
ভাইব্যা চিন্তা হইল কাইল পুত্র ডিঙ্গাধর।।
শশ বল্লার কামড়ে যেমুন মানুষ হয় ফানা।
সকল দুঃখের অধিক দুঃখ যার আছে দেনা।।