দেখতে দেখতে সোনা-রূপোয় রাজার বাড়ি ভরে গেল, তবু খালি বলেন-‘ঠেল, ঠেল, ঠেল!’
দিনের পর দিন যাঁতা ঠেলতে ঠেলতে মেনিয়া-ফেনিয়া কাহিল হয়ে পড়ল, তাদের পিঠে ধরে গেল, অবশ হয়ে এল, তবু রাজা খালি বলছেন-‘ঠেল, ঠেল, ঠেল!’ তখন কাজ ত করিয়ে নেবেই। কিন্তু মনে মনে তাদের বড্ড রাগ হল।
একদিন রাজা খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে আছেন, মেনিয়া-ফেনিয়া যাঁতা ঠেলছে। ঠেলতে ঠেলতে তারা বলল-‘দাড়াও, এই বেলা একটু মজা দেখাচ্ছি!’ বলে তারা গাইতে লাগল-
‘আয় ডাকাত-হুঁইরে হাঁ!
হাজার হাজার-হুঁইরে হাঁ!
মার মার-হুঁইরে হাঁ!
লাগা আগুন-হুঁইরে হাঁ!’
অমনি হাজারে হাজারে ডাকাত এসে দেশ ছেয়ে ফেলল। তারা জাহাজে চড়ে সাগর পার হেয় দেশ বিদেশে ডাকাতি করে বেড়ায়, তাদের বলে বোম্বেটে , তাদের সঙ্গে কেউ পারে না।
রাজা ঘুমুতেই লাগলেন। ডাকাতেরা তাঁদের সকলকে মেরে, যত টাকা কুড়ি লুটে নিয়ে গেল, মেনিয়া-ফেনিয়া শুদ্ধ সেই যাঁতাটাও নিয়ে জাহাজে তুলল।
তারপর ডাকাতদের সর্দার বলল-‘বাঃ বেশ হয়েছে। যাঁতাটার ভিতর থেকে যা চাই তাই বেরোবে! টাকা কড়ি ত আমারে ঢের আছে- নাই খালি নুন। এবারে আমাদের নুনের দুঃখ দূর হবে। ঠেল, ঠেল, ঠেল,-নুন বেরোক, নুন, নুন!’
মেনিয়া-ফেনিয়া যাঁতা ঠেলতে লাগল, আর কেবল নুন বেরোতে লাগল। নুন, নুন আর নুন! শেষে জাহাজ একেবারে ডুবেই গেল। সব ডাকাত তার সঙ্গে ডুবে মরল।
সেই ভয়ঙ্ক যাঁতা ডুববার সময়ে কি যে কাণ্ড হয়েছিল, কি বলব! সাগরের জল গর্হ হযে, হড়-হড় শব্দে জল তার চারদিকে ঘুরপাক খেতে লাগল,-যে ঘুরুনি আজো থামে নি!
আর সেই লবণের কি হল? আর হবে? সেই নুন সমুদ্রের জল ভেসে গেল। দুই দানবীতে মিলে কম নুন তোর বার করে নি, সাগরের সব জল তাতে লোনা হয়ে গেছে।
আমার কথায় বিশ্বাস না-হয়, মুখে দিয়ে দেখে আসতে পার।
সাতমার পালোয়ান
এক রাজার দেশে এক কুমার ছিল, তার নাম ছিল কানাই।
কানাই কিছু একটা গড়িতে গেলেই তাহা বাঁকা হইয়া যাইত, কাজেই তাহা কেহ কিনিত না। কিন্তু তাহার স্ত্রী খুব সুন্দর হাঁড়ি কলসি গড়িতে পারিত্ ইহাতে কানাইয়ের বেশ সুবিধা হইবারই কথা ছিল। সে সকল মেহন্নত তাহার স্ত্রী ঘাড়ে ফেলিয়া সুখে বেড়িয়া বেড়াইতে পারিত। কিন্তু তাহার স্ত্রী বড়ই রাগী ছিল, কানাইকে আলস্য করিতে দেখিলেই সে ঝাঁটা লইয়া আসিত। সুতরাং মোটের উপর বেচারার কষ্টই ছিল বলিতে হইবে।
একদিন কানাইয়ের স্ত্রী কতকগুলি হাঁড়ি রোদে দিয়ে বলিল, ‘দেখ যেন কিছুতে মাড়ায় না।’
কানাই কিছু চিঁড়ে আর ঝোলাগুড় এবং এবং একটা লাঠি লইয়া হাঁড়ি পাহারা দিতে বসিল। এক-একবার চিঁড়ে খায় আর এক-একবার হাঁড়ির পানে তাকাইয়া দেখে, কিছুতে মাড়াইল কি না। কানাইয়ের ঝোলাগুড়ের খানিকটা কেমন করিয়া হাঁড়ির উপর পড়িয়াছিল, অনেকগুলি মাছি রোসো!’ এই বলিয়া সে তাহার লাঠি দিয়া মাছিগুলিকে এমন এক ঘা লাগাইল যে তাহাতে মাছিও মরিয়া গেল, হাঁড়িও গুঁড়া হইয়া গেল।
কানাই গনিয়া দেখিল যে, সাতটা মাছি মরিয়াছে। তাহাতে সে লাঠি বগলে করিয়া ভারি গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিল। হাঁড়ি ভাঙ্গার শব্দ শুনিয়া তাহার স্ত্রী ঝাঁটা হাতে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি হয়েছে?’ কানাই কথা কয় না। তাহার স্ত্রী যতই জিজ্ঞাসা করে, সে খালি আরো গম্ভীর হইয়া যায়।
শেষটা যখন তাহার স্ত্রী বাড়াবাড়ি করিল, তখন সে চোখ লাল করিয়া বলিল, ‘দেখ, হিসেব করে কথা কোস। এক ঘায় সাতটা মেরেছি, জানিস?’
কানাই আর কাহারো সঙ্গে কথা কয় না। বেশি পীড়াপীড়ি করিলে খালি বলে, ‘হিসেব করে কথা কোস্। এক ঘায় সাতটা মেরেছি, জানিস?’
শেষে একদিন কানাই এক থান মার্কিন দিয়া মাথায় একটা পাগড়ি বাঁধিল। বনের ভিতর হইতে বাঁশ কাটিয়া একটা ভয়ানক মোটা লাঠি তয়ের করিল। তারপর পিরান গায়ে দিয়া কোমর বাঁধিয়া, ঢাল হাতে করিয়া, জুতা পায় দিয়া, রাজার বাড়িতে পালেয়ানগিরি করিতে চলিয়া যাইবার সময় তাহার স্ত্রীকে বলিয়া গেল-‘আমি আর তোদের এখানে থাকব না। আমি এক ঘায় সাতটা মারতে পারি।’
পথের লোক জিজ্ঞাসা করে , ‘কানাই, কোথায যাও?’ কানাই সে কথার কোন উত্তর দেয় না। সে মনে করিয়াছে যেন এখন আর কানাই বলিয়া ডাকিলে উত্তর দিবে না। সে এক ঘায় সাতটা মারিয়া ফেলিয়াছে! এখন কি আর তাহাকে কানাই ডাকা সাজে? এখন তাহাকে বলিতে হইবে, ‘সাতমার পালোয়ান।’
রাজার নিকট গিয়া কানাই জোড়হাত করিয়া দাঁড়াইল। রাজা তাহার সেই এক থান মার্কিনের পাগড়ি দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা কারিলেন,
‘তোমার নাম কি হে?’ কানাই বলিল, ‘মহারাজ, আমার নাম সাতমার পালোয়ান। আমি এক ঘায় সাতটাকে মারতে পারে।’
কানাই রাজার বাড়িতে পালোয়ান নিযুক্ত হইল। মাইনে পঞ্চাশ টাকা। এখন তার দিন সুখেই যায়।
ইহার মধ্যে একদিন সেই রাজার দেশে এক বাঘ আসিয়া উপস্থিত। সে মানুষ মারিয়া গরু বাছুর খাইয়া, দৌরাত্ম্য করিয়া দেশ ছারখার করিবার জোগাড় করিল। যত শিকারী তাহাকে মারিতে গেল, সব কটাকে সে জলযোগ করিয়া ফেলিল। রাজামহাশয় অবধি ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, ‘দেশ আর থাকে না।’
এমন সময় কোথাকার এক দুষ্ট লোক আসিয়া রাজার কানে কানে বলিল, ‘মহারাজশয়, এত যে ভাবছেন, তবে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে পালোয়ান রেখেছেন কি করতে? তাকে ডেকে কেন বাঘ মেরে দিতে হুকুম করুন না।’