পাহাড়ের নীচে নামিতে অনেক বেলা হইল। একটু একটু করিয়া ক্ষুধা বাড়িতে লাগিল কোনো দোকানে যাইতে হইলে অন্তত এক প্রহর চলিতে হইবে। সেই রোদে আর এক ঘন্টা চলাই অসম্ভব বোধ হইতে লাগিল। পথের ধারে দু-একটি গাছ দেখিলেই ইচ্ছা হইতেছিল যে সেইখানে শুইয়া পড়ি। কিন্ত একদিকে তৃষ্ণায় গলা শুকাইয়া যাইতেছে এবং অন্যদিকে ক্ষুধায় পেট জ্বলিতেছে। কি করিব কিছু ঠিক করিতে না পারিয়া পথের ধারে একটি বাড়ি খুজিয়া লইলাম। বাড়িতে উঠিয়া একটা বড় ঘরে গেলাম; সেখানে দুটি ছেলে বসিয়াছিল। আমি তাহাদের নিকট আমার ক্ষুধার কথা জানাইলাম, তাহারা ‘তুই’ ‘তুই’ করিয়া আমার কথার উত্তর দিতে লাগিল। একজন বলিল-
‘বাঙালী লোক চোর আর খ্রীষ্টান; বাঙালী লোককে কিছু দিব না।’
‘আমি ভদ্রলোক ব্রাহ্মন; চোর নই।’
‘যা তুই এখান থেকেঃ C-r-i-p crip : d-a-s-h dash.’
আমার তখন ঠাট্রার মেজাজ ছিল না। তথাপি এর পর আর হাসি থামাইতে পারিলাম না। তখন তাহাদের ধরণে কথা কহিতে লাগিলাম-
‘ওর মানে কি হোল?’
‘ ও ইংরাজি। Ram is ill. I will not let him run in the sun বাঙালী লোক চোর; যা তুই এখান থেকে।’
তোরা ইস্কুলে পড়িস?’
এবার যেন তাহারা কিছু ভয় পাইল। আমাদের মাষ্টার বড় বই পড়ে।’
‘তোমাদের মাষ্টারের চাইতে আমি কি কম একটা কিছু? এই দেখ ত!’
আমার পুঁটুলিতে যে বইগুলি ছিল, তাহার মধ্যে Lamb’d Tales ও ছিল। সেইখানা এখন বাহির করিলাম।
এইলা একটু পরিবর্তন দেখা গেল। তাহাদের মুখভঙ্গিতে বুঝা গেল যেন তাহারা মনে করিয়া লইয়াছে যে আমি একটা কিছু হইব। একজন মাথ চুলকাইতে চুলকাইতে উঠিয়া গেল। যে রহিয়া গেল, আমি তাহাকে আশ্বস্ত করিয়া তাহার সহিত আলাপ পরিচয়ের চেষ্টা করিতে লাগিলাম। তাহার কথায় বুঝা গেল যে তাহার দুভাই। সে ছোট। বাবা নাই; মা আছেনঃ ইস্কুলে পড়ে; টাকা আছে, চাকর চাকরানী আছে। বলা বাহুল্য, সে বাড়িতে তখনকার জন্য আমার বিশ্রামের সংস্থান হইল।
আমার জন্য একটি ছোট ঘর নিদিষ্ট করা হইল। আমি তাহাতে যাইয়া বসিলাম। তখন সকলের খাওয়া হইয়া গিয়াছে, সুতরাং নতুন আহারের আয়োজন করা হইল। একজন আসিয়া আমাকে স্নান করিতে বলিল। আমি কাছের একটা পুকুর হইতে স্নান করিয়া আসিলাম। আসিয়া দেখিলাম যে জল-খাবারের জন্য কতকগুলি ভিজানো চাল আর কিছু সন্দেশ লইয়া বড় ছেলেটি আমার ঘরে বসিয়া আছে। চালগুলি ভিজিয়া ঠিক ভাতের মত হইয়াছে। সেখানে খাবার সময় ঐরূপ চাল অনেককে খাইতে দেখিয়াছি। আমি খাইতে বসিলাম। ছেলেটি আমার কাছে বসিয়া রহিল। তাহার ভাব ভঙ্গিতে বোধ হইতে লাগিল যেন কিছু বলিতে আসিয়াছে। কিছুকাল পরেই সে আমার গায় মাথায় হাত বুলাইতে লাগিল। আমি কিছু চমৎকৃত হইয়া তাহার দিকে চাহিলাম, সে বলিল, ‘মা ব’লে দিয়েছেন আপনি ব্রাহ্মণ, আপনি শাপ দিলে আমার অনিষ্ট হবে। আমি আপনাকে মন্দ কথা বলেছি।’
‘তোমার উপর রাগ করি নাই। তোমার কথায় আমার কিছুমাত্র অনিষ্ট হয় নাই। আমি ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিব, যেন তিনি তোমার ভাল করেন।’ তাহাকে বুঝানো কিছু কষ্টকর বোধ হইল। কিন্ত শেষটা সে যেন সুখী হইল এবং বলিল, ‘তবে যাই, মা’র কাছে বলিগে।’
বেলা প্রায় শেষ হইয়া আসিলে সেই ছেলে দুটির নিকট হইতে বিদায় লইয়া বাহির হইলাম। সেদিন রাত্রিতে এক বাজারে মুদীর দোকানে ছিলাম। তারপর দুই দিন ঐ ভাবে গেল। সারদিন পথ চলিতাম; কেবল দু-বেলা খাবার জন্য কোনো মুদীর দোকানে উঠিতাম। রাত্রিতে কোন মুদীকে পয়সা দিয়া তাহার ঘরে থাকিবার জায়গা পাইতাম। তৃতীয় দিন রাত্রিতে থাকিবার জন্য আর মুদীর ঘর পাইলাম না। কাজেই একজন গৃহস্থের বাড়ি যাইতে হইল। গৃহস্থ জায়গা দিতে কোনো আপত্তি করিলেন না। কিন্ত খাওয়া শেষ হইলে ‘কড়া’ ‘বগুণো’ সব দেখাইয়া বলিলেন, ‘কাল চলে যাবার আগে এইগুলো মেজে দিয়ে যেতে হবে। তুমি বাঙালী, তোমার এঁটো কে নেবে?’ আমি মহা বিপদে পড়িলাম। বলিলাম, ‘ওগুলো আমি ছুঁই নাই। তবে আমি যা যা ছুঁয়েছি সেগুলো দাও, এখনি মেজে দিচ্ছি।’ একখানা থালা আর একটি বগুণো (বগুণোতে ডাল ছিল) আমার ঘাড়ে চাপিল। তিনি বাড়ির কাছে একটা পুকুর দেখাইয়া দিলেন; আমি তথায় যাইয়া সমস্ত পরিস্কার করিয়া আসিলাম। প্রায় অর্ধঘন্টা সময় লাগিল।
পরিশ্রমের পর সুনিদ্রা হইল। পরদিন গৃহস্থ ডাকিয়া ঘুম ভাঙ্গাইলেন, উঠিয়া দেখি সূর্য উঠিয়াছে। তাড়াতাড়ি পুঁটুলি হাতে করিয়া বাহির হইলাম। গৃহস্থের নিকট বিদায় লইবার সময় ফা-যাইবার পথ জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন, ‘একটা বড় মাঠ, তারপর একটা পাহাড়, তারপর ফা-। একই পথ, ভূল হবার জো নাই।’
কিছুদূর হাঁটিয়াই একটা মাঠে আসিলাম। সেখানে পথিকদিগের জন্য একটা ঘর আছে। তথায় একজনার সাহিত সাক্ষাৎ হইল। তাহার সঙ্গে একটা ঘোড়া। সে আমাকে দেখিয়াই বলিল, ‘বেশ, চল। একজন সঙ্গীর জন্য বসিয়াছিলাম। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সঙ্গীর প্রয়োজন কি?’ সে বলিল, ‘তুমি আর কখনো এখানে চল নাই? একা গেলে খেয়ে ফেলবে!’ আমার ভয় হইল।
মাঠের এপাশ থেকে ওপাশ দেখা যায় না। অতি কম চওড়া পথ; দশ বারো হাত অন্তর ছোট ছোট খসখসের ঝোপ। জীবজন্তুর মধ্যে এক জাতীয় পাখি। পাখিটি একটি চড়াই অপেক্ষা কিঞ্চিৎ বড়, গায়ের রং সবুজ; ঠোট সরু এবং লম্বা, স্বভাব অত্যন্ত চঞ্চল। ক্রমাগত একই রূপ শব্দ করিতেছে-”টিরিরণ টিরিরণ টিরিরণ।” লেজে একটা নতুনত্ব আছে। লেজের মধ্যদেশ হইতে প্রায় দেড় ইঞ্চি লম্বা একটি সূচীর মত বাহির হইয়াছে। আমার সঙ্গী বলিল, ‘শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ছুঁচ চুরি করেছিলেন। তাতেই ঐ শাস্তি।’ অন্য কিছু না থাকাতে ঐ পাখিকেই বারবার ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলাম।