একদিন স্কুল হইতে ছুটি পাইয়া বাড়ি আসিলাম; সতীশও আসিল। বাবা বাড়ি ছিলেন না। বাড়ির অন্যান্য লোকও চুপ করিয়া বিশ্রাম করিতেছিল। চুপি চুপি কয়েকখানা কাপড় দিয়া একটি পুটঁলি বাঁধিলাম। তারপর বাবার বাক্স হইতে কতকগুলি টাকা লইয়া দুজনে চোরের মত বাড়ির বাহির হইলাম। পাছে কেহ আসিয়া ধরে, সেই ভয়ে দুজনে মাঝে মাঝে দৌড়াইতে লাগিলাম। এইরূপে স্যা পর্যন্ত হাঁটিয়া এক বাড়িতে যাইয়া উঠিলাম।
সেই বাড়ির কর্তা আমাদের অবস্থা দেখিয়া বড় দুঃখিত হইলেন। আমাদের সম্বন্ধে যা যা কথা সমস্ত জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। আমরা কোন কথারই ঠিক উত্তর দিই নাই। স্থানে স্থানে দু-একটি কথা গড়িয়া কহিতে হইল। তিনি আমাদের কথায় বুঝিয়া লইলেন যে, আমরা দুজন পথ হারাইয়া ঘুরিতেছি। বলিলেন, ‘কাল আমি একজন লোক দিয়া তোমাদের দুজনকে বাড়ি পাঠাইয়া দিব।’
খাইবার সময় ভদ্রলোকটি আমাদের সম্মুখে বসিয়া থাকিলেন, আহার শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠিলেন না। একটি কুঠুরিতে আমাদের দুজনের ঘুমাইবার বন্দোবন্ত করিয়া দেওয়া হইল। সেখানে আর কেহ ঘুমাইতে আসিল না। আমি কিছু সুবিধা বোধ করিলাম। ভাবিলাম কর্তা যাহা বলিলেন তাহা কাজে করিলে আর বড়লোক হওয়া হইবে না; সুতরাং কেহ জাগিবার পূর্বে কর্তাকে ধন্যবাদ না দিয়া চলিয়া যাওয়া ঠিক হইল। সতীশকে ডাকিলাম, ‘সতীশ! সতীশ!’-সতীশ কথা কয় না। সতীশের চক্ষে জল পড়িতেছে। কর্তার কথায় সতীশের মন ফিরিয়া গেল নাকি? বাস্তবিকই তাই, অনেক পীড়াপীড়ি করার পর বলিল, ‘আমি তোমার সঙ্গে যাইব না।’ আপনারা কি মনে করিতেছেন? সতীশের কথা শুনিয়া আমার মনের ভাব কিপ্রকার হইল? বড়লোক হওয়ার ইচ্ছাটা আমার এত বেশী হইয়াছিল যে, বাড়ি ছাড়িয়া অবধি আমার বোধ হইতেছিল-যেন বড়লোকের কাছাকাছি একটা কিছু হইয়াছি। সতীশকে আমি কাপরুষ মনে করিতে লাগিলাম। সতীশের মা বাপ আছে, আমারও মা বাপ আছেন। প্রভেদ এই যে, আমি স্বার্থপর; সতীশ তাহা নহে। সতীশের মনে যে-সকল চিন্তা উঠিতেছিল, আমার অন্তঃকরণে তাহা স্থান পাইল না। আমি সতীশের অবস্থা বুঝিতে পারিলাম না। ম বাপের মনে কষ্ট দেওয়া আমার ইচ্ছা ছিল না; কিন্ত নিজের কথা লইয়া এত ব্যস্ত ছিলাম যে তাঁহাদের কথা ভাবিবার অবসরই পাই নাই। নানা চিন্তার মধ্যে ঘুম আসিল।
ঘুমাইতে ঘুমাইতে স্বপ্নে দেখিলাম যে, আমি বাড়িতে কি একটা কথা লইয়া মার সঙ্গে রাগারাগি করিয়াছি, মা কত সাধিতেছেন, আমার ভ্রুক্ষেপ নাই; রাগ যেন ক্রমেই বাড়িতেছে। মার চক্ষে জল পড়িতেছে দেখিয়া যেন আমার প্রতিহিংসার ভাবটা চরিতার্থ হইতে লাগিল। আমি দাত খিঁচাইয়া মাকে বিদ্রূপ করিতে লাগিলাম। মা আমার হাত ধরিতে আসিলেন; আমি পাশের একটা গাছে উঠিতে চেষ্টা করিলাম। হঠাৎ পা পিছলাইয়া পড়িয়া যাইতেছিলাম; এমন সময় আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। স্বপ্নের কথা ভাবিয়া চক্ষে দুফোঁটা জল আসিল; কিন্ত আবার সে বড়লোক হওয়ার কথা। সতীশের মন ফিরিয়া গিয়াছে। সতীশ জাগিয়া আর যাইতে চাহিবে না, হয়ত আমারও যাওয়া হইবে না। রাত হয়ত আর বেশী দেরী নাই; এই বেলা সতীশকে না বলিয়া যাওয়াই ভাল। আমি আস্তে আস্তে উঠিলাম। আমার কাপড় আর টাকাগুলি লইয়া বাহির হইলাম। রাত্রি তখনো অনেক ছিল, কিন্ত আমার বোধ হইতে লাগিল যেন এই ভোর হইয়া আসিতেছে। একটা বড় রাস্তা ধরিয়া চলিলাম। অনেকক্ষণ হাঁটিলাম, কিন্ত রাত ফুরায় না। রাস্তাটা একটা নদীর ধারে যাইয়া শেষ হইয়াছে; আমিও সেইখানে যাইয়া থামিলাম-তারপর যাই কোথা? রাস্তাটা নিশ্চয়ই ওপার যাইয়া আবার চলিয়াছে, কিন্ত ওপারে যাই কেমন করিয়া? এতক্ষনে রাত ফুরাইল না। হয়ত আরো অনেক দেরী। ঘাটে একখানি নৌকা বাঁধা ছিল-নৌকার ছই নাই। একজন লোককে অনায়াসে ওরূপ নৌকা চালাইতে দেখিয়াছি, আমার বোধ হইতে লাগিল, আমিও পারি। নৌকায় উঠিতে বিলম্ব হইল না। যে লগিটিতে নৌকা বাঁধা ছিল, তাহা তুলিয়া লইলাম। ডাঙ্গায় ভর করিয়া ঠেলিয়া নৌকা জলে ভাসাইয়া দিলাম। জলের গায় এত জোর আগে ভাবি নাই। শোঁ শোঁ করিয়া নৌকার গায় জল বাধিতে লাগিল; নৌকাখানা ঘুরিয়া গেল। হঠাৎ ঘুরিবার সময় তাড়াতাড়ি লগিটি ছাড়িয়া দিলাম। নৌকা ঘুরিয়া ঘুরিয়া ডাঙ্গা হইতে অনেক দুরে যাইয়া পড়িল-স্রোতে ভয়ানক বেগের সহিত ভাসিয়া যাইতে লাগিল, আমি কিছুকাল হতবুদ্ধি হইয়া থাকিলাম।
বিপদের পরিমানটা প্রথমে তত বুঝি নাই, শেষে কিছু কিছু করিয়া হুঁশ হইতে লাগিল। মাথা ঘুরিয়া গেল। দুহাতে চোখ ঢাকিয়া বসিয়া পড়িলাম। ঢেউগুলি তড়াক তড়াক করিয়া নৌকাখানিকে দোলাইতে লাগিল, তখন মায়ের সেই মুখখানি মনে হইল। কেন বাড়ি ছাড়িয়া আসিলাম? সেই অন্ধকার রাত্রি, ভয়ানক নদী, আর বাড়ির ছোট কুঠুরিটি-সেই কোমল সুন্দর বিছানাটি মনে হইল। দুই চক্ষে জল পড়িতে লাগিল। সেই আঁধারে পড়িয়া, মা মা বলিয়া কাঁদিতে লাগিলাম। কেন সতীশের সঙ্গে গেলাম না, তাহাকে কেন ছাড়িয়া আসিলাম?
এইভাবে কতক্ষণ ছিলাম বলিতে পারিব না। হঠাৎ নৌকাখানি একদিকে যাইয়া ঠেকিল। চমকিয়া দেখিলাম, কতকগুলি বড় নৌকা, তাহারি একটাতে আমার নৌকা ঠেকিয়াছে। আমি সেই মূহুর্তের জন্য আশ্বস্ত হইলাম। কিন্ত তার পক্ষেণেই নৌকা হইতে কতকগুলি কালো অর্ধ উলঙ্গ লোক বাহির হইয়া কেঁউ মেঁউ করিয়া কি বলিতে লাগিল। আমি বুঝিতে পারিলাম আমাকে গালি দিতেছে তাহারা আমার কথা বুঝিতে পারিল বলিয়া বোধ হইল না। আরো বেশী গালাগালি দিতে লাগিল। ক্রমে অন্যান্য নৌকার লোক আসিয়া গোলমালে যোগ দিল। আমার কথা শুনিয়া সকলেই ঐ লোকগুলিকে গালি দিতে লাগিল। একটি ভদ্রলোক সেখানে ছিলেন। তিনি দয়া করিয়া আমাকে তাঁহার নৌকায় লইয়া গেলেন, নিজ হাতে আমার পুটলিটি যত্ন সহকারে এককোণে রাখিয়া দিলেন। তারপর আমাকে বলিলেন, ‘আমি কা- যাইতেছি; তোমার আপত্তি না থাকিলে আমার সঙ্গে যাইতে পার, আমার বাড়িতে কোন ক্লেশ হইবে না।’ আমি তাঁহার সঙ্গেই চলিলাম।