কোন ভাল বিষয়ে খুব ভাল হইলে বড়লোক হয়। যেমন বিদ্যাসাগর মহাশয় বড়লোক, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বড়লোক, লর্ড রিপন বড়লোক, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার বড়লোক, সুরেন্দ্র বাবু বড়লোক, ইত্যাদি, ইঁহাদের সকলেই এক বিষয়ের জন্য বড় হন নাই। কিন্ত একটু চিন্তা করিলেই দেখিবে, ইঁহাদের যাঁহার মধ্যে যেটুকু ভাল তাহার জন্যই তাঁহাকে বড়লোক বলা হয়। বড় চোরকেও বড়লোক বলা হয় না, বড় ডাকাতকেও বড়লোক বলা হয় না।
আর এক কথা। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিদ্যার জন্য আমরা তাঁহাকে অত বড়লোক বলি না। মহেন্দ্র বাবু নিজের ঘরে কবাট দিয়া বিজ্ঞান চর্চা করিলে আমরা তাঁহাকে অত বড়লোক বলিতাম না, অন্তত তাঁহার প্রতি আমাদের অত শ্রদ্ধা হইত না। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, লর্ড রিপন, ইঁহারা কে কি শাস্ত্র অধিক জানেন, কি কিছুই জানেন না, তাহার হিসাবও হয়ত আমরা কেহ দিতে পারিব না। সুরেন্দ্র বাবুর স্কুল আছে, সেখানে তিনি পড়ান, এজন্য তাঁহাকে কেহ বড়লোক বলে না। যিনি যে পরিমানে লোকের উপকার করিতেছেন, তিনি সেই পরিমানে লোকের ভালবাসা পাইতেছেন। বড়লোক এবং ভাল লোক, এ উভয়ই যথার্থ বড়লোক। বড়লোক হওয়া যেরূপই কঠিন হউক না কেন, ভাল লোক চেষ্টা করিলেই হওয়া যায়। এবং তাহাই আগে হওয়া উচিত। কাহারো যদি এক কোটি টাকা থাকে, তাঁহাকে সুদ্ধ ঐ টাকাগুলির জন্য বড়লোক বলিব না। তিনি নিজের সদ্গুনের সাহায্যে উহা উপার্জন করিয়া থাকিলে অবশ্য তাঁহাকে বড়লোক বলিব। কিন্ত যখন দেখি ঐ টাকা দিয়া দেশের উপকার করিতেছেন, তখনই তাঁহাকে যথার্থ বড়লোক বলিব। কারণ, তখন তিনি বড়লোক এবং ভাল লোক উভয়ই হইয়াছেন। বড়লোক বড়, ভাল লোক ভাল, বড়লোক ভাল হইলে বড় ভাল।
ভীতু কামা (জুলু দেশের গল্প)
এক যে ছিল ছোট ছেলে, তার নাম ছিল কামা। সে এতটুকু মানুষ ছিল, তার পেটটি ছিল বড়, হাত-পা ছিরল কাঠি কাঠি। সে অন্য ছেলেদের সঙ্গে জোরে পারত না, খেলতে গেলে খালি তাদের হাতে মার খেত। বেচারা চুপ করে সে সব সয়ে থাকত, তার গায়ে জোর ছিল না, কাজেই কি নিয়ে ঝগড়া করবে? তার ইচ্ছা হত যে সে খুব ভারি ভারি কাজ করে, খালি গায় জোর ছিল না বলে সেসব কিছু করতে পারত না।
গ্রামের লোকেরা তাকে বলত ভীতু কামা। তারা চাইত যে, গ্রামের ছেলে পিলে খুব ষণ্ডা আর সাহসী হয়। তাদের সর্দার যখন দেখল যে কামা তার কিছুই হচ্ছে না, তখন সে তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিল।
কামা ভাবল-ওমা! কি হবে? আমি কোথায় যাব? গ্রাম থেকে ত আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন পরীর পাহাড়ে গিয়ে দেখি, পরীরা আমাকে কি করে!
সে দেশে একটা গোলপানা পাহাড় ছিল, তাতে পরীরা থাকত! সেখানকার লোকেরা তাদের ভয়ে কেউ সেখানে যেত না। কামা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেই পরীর পাহাড়ে গিয়ে উপস্থিত হল, আর অমনি খুদে খুদে কালো সব পরী এসে তাকে ঘিরে ফেলল। তারা জুলু দেশের পরী কিনা, তাই কালো, তাদের ফড়িং-এর মতন ডানা আর হাতে ঢাল আর বর্শা। কামাকে তাদের পাহাড়ে আসতে দেখে তারা এমনি চটেছে যে কি আর বলব। তাদের রাজা এসে তাকে বলল-‘তুই যে আমাদের পাহড়ে এলি? দাঁড়া, এখনি তোকে মেরে ফেলছি।’
কামা কাঁপতে কাঁপতে হাতজোড় করে বলল-‘দোহাই রাজামশাই, আমাকে মারবেন না। আমি ভীতু কামা, আপনাদের কোন ক্ষতি করবার ক্ষমতা আমার নাই, আমাকে মেরে কি হবে?
পরীর রাজা বলল-‘বটে? তুই ভীতু কামা? হাঁ হাঁ, তোর কথা শুনেছি বটে। তোর গায় জোর নাই, কিন্তু তোর মনটাতে সাহস আছে। আচ্ছা বাছা, তোর আর অমনি করে ভয়ে কাঁপতে হবে না, আমি তোকে পালোয়ন করে দিচ্ছি।’
বলে পরীর রাজা মাটিতে একটা সিংহের চামড়া বিছিয়ে কামাকে বলল-‘এর উপর শুয়ে একটু ঘুমো দেখি?’ কামা সেই সিংহের চামড়ার উপরে ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর যখন তার ঘুম ভেঙ্গে ছে, তখন সে দেখে, তার আর সেই কাঠি কাঠি হাত পা নাই, সে ভারি এক পালোয়ান হয়ে গেছে। আর তার মনে হচ্ছে, যেন সে এক থাপ্পড়ে হাতি মেরে ফেলতে পারে!
তখন কামা চারদিকে চেয়ে দেখল যে, সেই পাহাড়ের উপর সে একলাটি দাঁড়িয়ে আছে। পরীদের একজনও সেখানে নাই, তার জন্য মস্ত বড় ঢাল আর বর্শা রেখে কোথায় চলে গেছে।
সেই ঢাল আর সেই বর্শা হাতে করে কামা পাহাড় থেকে নেমে ঘরের দিকে চলল। খানিক দূর এসে সে দেখল যে ভয়ঙ্কর একটা সিংহ হাঁ করে তাকে খেতে এসেছে। সে কি আর এখনর সিংহকে ডরায়? তার বর্শার এক খোঁচা খেয়েই সেই সিংহ জিব বার করে, চোখ উলটিয়ে মরে গেল।
সেই সিংহটাকে কাঁধে ফেলে, ঢাল আর বর্শা হাতে যখন কামা গ্রামে এসে উপস্থিত হয়েছে, তখন ত তাকে দেখে আর কারুর মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। গ্রামের জোয়ানেরা এসে তার ঢাল আর বর্শা আর সিংহটাকে নিয়ে কত টানাটানি করল, কিন্তু কেউ তাকে একটু নাড়াতেও পারল না!
গ্রামের সর্দার আগে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, এখন সে তাকে কি করে আদর দেখাবে, তাই ভেবে ঠিক করতে পারছে না! তখনি সে তাকে একখানি ঘর আর অনেকগুলি ষাড় দিয়ে দিল।
এখন আর কামার কোন দঃখ নাই। সে সেই ঘরখানিতে তার মাকে নিয়ে থাকে। আগে যারা বলত ‘ভীতু কামা’-এখন তারা বলে ‘কামা পালোয়ান।’
ভুতো আর ঘোঁতো
ভুতো ছিল বেঁটে আর ঘোঁতো ছিল ঢ্যাঙা। ভুতো ছিল সেয়ানা, আর ঘোঁতো ছিল বোকা। দুজনে মিলে গেল কুলগাছ থেকে কুল পড়াতে। ঘোঁতো কিনা ঢ্যাং, সে দুহাতে খালি কুলই পাড়ছে। ভুতো কিনা বেঁটে, তাই সে কুল নাগাল পায় না, সে শুধু ঘোঁতোর পাড়া কুল খাচ্ছে।