ঘ্যাঁঘাসুরের মুলুকে যাইতেছে শুনিয়া, সকলে তাহাকে আদর করিয়া জায়গা দেয়। একদিন রাত্রিতে এইরূপে সে একজন খুব ধনী লোকের অতিথি হইয়াছে। সেই ধনী অনেক কথাবার্তার পর তাহাকে বলিল, ‘বাপু, তুমি ঘ্যাঁঘাসুরের দেশে চলেছ শুনেছি, সে অনেক বিষয়ের খবর রাখে। আমার লোহার সিন্ধুকের চাবিটা হারিয়ে ফেলেছি, ঘ্যাঁঘা তার কোন সান বলতে পারে কি না, জিজ্ঞাসা কোরো তো।’ মানিক বলিল, ‘আচ্ছা মশাই, আমি জেনে আসব।’ আর-একদিন সে আর-এক বড়লোকের বাড়িতে অতিথি হইয়াছে। সেই বড়লোকের মেয়ের ভারী অসুখ। তাহার বেয়ারামটা যে কি, কোনো ডাক্তার কবিরাজ তাহা ঠিক করিতে পারে না। মেয়ে দিন দিন খালি রোগা হইয়া যাইতেছে। সেই বড়লোক মানিককে খুব যত্ম করিয়া খাওয়াইয়া তারপর বলিলেন, ‘আমার মেয়ের অসুখ কিসে সারবে, ‘এই কথাটা যদি ঘ্যাঁঘার কাছ থেকে জেনে আসতে পার, তবে বড় উপকার হয়।’ মানিক বলিল, ‘অবশ্যি মশাই, আমি নিশ্চয়ই জেনে আসব।’
এইরূপে একমাস চলিয়া মানিক অজানা নদীর ধারে আসিয়া ওপারে ঘ্যাঁঘাসুরের সোনার বাড়ি দেখিতে পাইল। অজানা নদীর নৌকা নাই, খেয়া নাই, এক বুড়ো সকলকেই কাঁধে করিয়া পার করে। মানিকও তাহারি কাঁধে চড়িয়া নদী পার হইল। বুড়ো তাহাকে বলিল, ‘বাপু, আমার এই দুঃখ কবে দূর হবে, ঘ্যাঁঘার কাছে জিজ্ঞেস কোরো ত! আমার খাওয়া নাই, দাওয়া নাই, খালি কাঁধে ক’রে দিনরাত্তির মানুষই পার করছি। ছেলেবেলা থেকে এই করছি, আর এখন বুড়ো হয়ে গেছি।’ মানিক বলিল, ‘তোমার কিছু ভয় নেই, আমি নিশ্চয়ই তোমার কথা জিজ্ঞেস করব!’
নদী পার হইয়া মানিক ঘ্যাঁঘার বাড়িতে গেল। ঘ্যাঁঘা তখন বাড়ি ছিল না; ঘেঁঘী ছিল। ঘেঁঘী তাহাকে দেখিয়া বলিল, ‘পালা বাছা, শিগ্গির পালা। ঘ্যাঁঘা তোকে দেখতে পেলেই গিল্বে!’ মানিক বলিল, ‘আমি যে ঘ্যাঁঘার লেজের একগাছি পালক চাই। সেটি না নিয়ে কেমন ক’রে যাব? আর সেই যাদের চাবি হারিয়ে গেছে সেই চাবিটি কোথায় আছে? আর যাদের মেয়ের অসুখ, তার ওষুধ জেনে যেতে বলেছে। আর যে বুড়ো পার ক’রে দিলে, সে বাড়ি যাবে কেমন ক’রে?
ঘেঁঘী বলিল, ‘প্রাণটি নিয়ে কোথায় পালাবে, না আবার তার পালক চাই, আর তাকে একশো খবর বলে দাও। তুই কে রে বাপ? মানিক বলিল, ‘আমি মানিক। পালক না নিয়ে গেলে রাজা মেয়ে বিয়ে দেবে না; একগাছি পালক আমার চাই।’
হাজার হোক স্ত্রীলোক। মানিককে দেখিয়া ঘেঁঘীর দয়া হইল। সে বলিল, ‘আচ্ছা বাপু, তাহলে তুই খাটের তলায় লুকিয়ে থাক্’ তোর ভাগ্যে থাকলে হবে এখন।’ মানিক ঘ্যাঁঘার খাটের তলায় লুকাইয়া রহিল।
সন্ধ্যার পর ঘ্যাঁঘাসুর বাড়ি আসিল। ঘেঁঘী তাড়াতাড়ি পা ধুইবার জলটল দিয়া সোনার থালায় খাবার হাজির করিল। ঘ্যাঁঘার মেজাজটা বড়ই খিটখিটে; সবটাতেই দোষ ধরে। বাড়ি আসিয়াই সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানিতে লাগিল, আর বলিতে লাগিল, ‘মানুষের গন্ধ কোত্থেকে এল? হুঁ হুঁ-মানুষের গন্ধ। মানুষ দে, খাই।
ঘ্যাঁঘার কথা শুনিয়া খাটের তলায় মানিকলালের মুখ শুকাইয়া গেল, ঘেঁঘীর বুক ধড়াস্ ধড়াস্ করিতে লাগিল। সে অনেক কৌশল করিয়া ঘ্যাঁঘাকে বুঝাইল যে, একটা মানুষ আসিয়াছিল, কিন্তু সেটা ঘ্যাঁঘার নাম শুনিয়াই পলাইয়াছে। ইহাতে ঘ্যাঁঘা কিছু শান্ত হইয়া খাবার খাইতে বসিল।
খাওয়া শেষ হইলে, ঘ্যাঁঘা খাটে শুইয়া নিদ্রা গেল। ঘুমের ভিতর তাহার লম্বা লেজটি লেপের বাহিরে আসিয়া খাটের পাশে ঝুলিয়া পড়িয়াছে। সেই লেজের আগায় অতি চমৎকার পালকের গোছা। মানিক খাটের তলায় অপেক্ষা করিয়া আছে, লেজ দেখিয়াই, সে খ্যাচ করিয়া একটি পালক ছিঁড়িয়া লইল। অমনি ঘ্যাঁঘা ব্যস্তসমস্ত হইয়া উঠিয়া বলিল, ‘ঘেঁঘী, আমার লেজ ধরে যেন কে টানলো। হুঁ হুঁ মানুষের গন্ধ!’
ঘেঁঘী বলিল, ‘তোমার ভুল হয়েছে। অত বড় পালকের গোছা কোথায় আটকে লেজে টান পড়েছে। আর মানুষ ত একটা এসেছিল বলেছি, এ তারই গন্ধ। সেই মানুষটা কত কথা বললে। সেই কাদের বাড়ি লোহার সিন্ধুকের চাবি হারিয়ে গেছে-ঘেঁঘীর কথা শেষ হইতে না দিয়াই ঘ্যাঁঘা বলিল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ! সেই লোহার সিন্ধুকের চাবি! আমি জানি! সেটাকে তাদের খোকা গদির ফুটোর ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে।’ ঘেঁঘী বলিল, ‘আবার কাদের মেয়ের কি অসুখ-।’ অমনি ঘ্যাঁঘা বলিল, ‘কোনা ব্যাঙে ওর চুল নিয়ে গেছে, ঘরের কোনেই তার গর্ত। ঐখান থেকে খুঁড়ে সেই চুল আনলেই মেয়ের ব্যামো সারবে।’ আবার ঘেঁঘী বলিল, ‘যে লোকটা মানুষ ঘাড়ে করে নদী পার করে-?’ ঘ্যাঁঘা বলিল, ‘সেটা একটা মস্ত গাধা। একজনকে কেন নদীর মাঝখানে নামিয়ে দেয় না। তাহলেই ত সে বাড়ি যেতে পারে। যাকে নামিয়ে দেবে, সে-ই মানুষ পার করতে থাকবে!’
মানিকের সকল কাজই আদায় হইল। এখন রাত পোহাইলে ঘ্যাঁঘা বাহিরে চলিয়া যায়, আর সেও বাহিরে আসিতে পারে। রাত ভোর হইলে ঘ্যাঁঘা জলখবার খাইয়া বেড়াইতে বাহির হইল। ঘেঁঘীও মানিককে পেট ভরিয়া খাওয়াইয়া বিদায় করিল।
এরপর প্রথমেই সেই বুড়োর সঙ্গে দেখা। বুড়ো জিজ্ঞাসা করিল, ‘আমার কথা কিছু হল?’ মানিক বলিল, ‘সে হবে এখন, আগে পার কর, আমার বড্ড তাড়াতাড়ি।’ বুড়ো মানিককে কাঁধে করিয়ে পারে লইয়া গেলে পর ডাঙায় উঠিয়া মানিক বলিল, ‘এরপর একজনকে মাঝখানে নামিয়ে দিয়ো; তা হলেই তোমার ছুটি।’ এই কথা শুনিয়া বুড়ো মানিককে অনেক ধন্যবাদ দিয়া বলিল, ‘ভাই, তুমি আমার এমন উপকারটা করলে, ‘আমার ইচছা হচ্ছে, তোমাকে আর দুবার কাঁধে করে পার করি।’ মানিক বলিল, তুমি দয়া করে যা করেছ তাই ঢের। আর আমার বুড়ো মানুষের কাঁধে চড়ে কাজ নেই। আমি এখন দেশে চললাম।’