মানিককে সকলেই একটু বোকা মনে করে। কাজেই তাহাকে আর লেবুর ঝুড়ি দিয়া রাজার বাড়ি পাঠাইতে কেহ বলিল না। কিন্তু সে যাইবার জন্য একেবারে সাজিয়া গুজিয়া প্রস্তুত হইয়া আছে। যতক্ষণ না চাষী তাহাকে যাইতে বলিল, ততক্ষণ তাহাকে কিছুতেই ছাড়িল না। শেষটা তাহাকেও এক ঝুড়ি লেবু দিয়া পাঠাইতে হইল।
পথে সেই একহাত লম্বা মানুষের সহিত মানিকেরও দেখা হইল। একহাত লম্বা মানুষ জিজ্ঞাস করিল, ‘ঝুড়িতে কি ও?’ মানিক বলিল, ‘ঝুড়িতে লেবু আছে, তাই খেয়ে রাজার মেয়ের অসুখ সারবে।’ একহাত লম্বা মানুষ বলিল, ‘আচ্ছা তাই হোক।’
রাজবাড়িতে ঢুকিতে মানিকের যার পর নাই মুশকিল হইয়াছিল। অনেক মিনতি আর হাত জোড়ের পর দারোয়ানেরা তাহাকে পথ ছাড়িয়া দিল আর বলিল, ‘দেখিস, যেন ব্যাঙ কি ঝিঙের বীচি-টিচি হয় না। তা হলে কিন্তু তোর প্রাণটা থাকবে না।’
যাহা হউক মানিকের ঝুড়িতে লেবুই পাওয়া গেল। রাজামহাশয় ত খুবই খুশী! তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর লেবু পাঠাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘কেমন হয়, আমাকে খবর দিস!’ খবরের আশায় রাজামহাশয় বসিয়া আছেন, এমন সময় মেয়ে নিজেই খবর লইয়া উপস্থিত! সেই লেবু মুখে দিতে না দিতেই তাহার অসুখ একেবারে সারিয়া গিয়াছে!
ইহাতে রাজামহাশয় যার পর নাই আনন্দিত হইলেন, কিন্তু তাহার পরেই ভাবিতে লাগিলেন-‘তাই ত, করিয়াছি কি! এখন যে চাষীর ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে হয়!’ এই ভাবিয়া রাজামহাশয় স্থির করিলেন যে, চাষীর ছেলেকে যেমন করিয়াই হউক ফাঁকি দিতে হইবে।
মানিকলাল ভাবিতেছে, ‘এরপর বুঝি মেয়ে বিয়ে দিবে।’ এমন সময় রাজামহাশয় তাহাকে বলিলেন, ‘বাপু, তুমি কাজটা বেশ ভালই করিয়াছ, কিন্তু রাজার মেয়ে বিবাহ সহজ কথা নয়। আগে আর-একখানা কাজ করিয়া দাও, তারপর দেখা যাইবে কি হয়। জলে যেমন চলে, ডাঙায়ও তেমনি চলে, এইরূপ একখানা নৌকা আমাকে গড়িয়া না দিতে পারিলে, তোমার কোন আশাই নাই।’
মানিক ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া বিদায় হইল। তারপর বাড়ি আসিয়া সকল কথা বলিল।
বাড়ির সকলেই মানিককে বোকা ঠাওরাইয়া রাখিয়াছিল। সুতরাং তাহারা মনে করিল যে, মানিক যখন রাজার মেয়েকে ভাল করিয়া আসিয়াছে, তখন নৌকাখানা ইচ্ছা করিলেই যে-সে তয়ের করিতে পারে।
যদু একখানা কুড়াল লইয়া নৌকা গড়িতে চলিল। বনের ভিতর হইতে গাছ কাটিয়া সেখানেই কাজ আরম্ভ করিয়া দিল। ইচ্ছা, সেইদিনই নৌকা প্রস্তুত করিয়া ফেলে। পরিশ্রমেরও কসুর নাই। এমন সময় কোথা হইতে সেই একহাত লম্বা মানুষ আসিয়া উপস্থিত। ‘কিহে যদুনাথ, কি হচ্ছে?’-‘গামলা’। আচ্ছা, তাই হোক।’
‘তাই হোক’ বলিয়া একহাত লম্বা মানুষ চলিয়া গেল। যদুও নৌকা গড়িতে লাগিল। কিন্তু সে যত পরিশ্রম করে, তাহার সমস্তই বৃথা হয়। সেই সর্বনেশে কাঠ খালি গামলার মত গোল হইয়া ওঠে, নৌকার মতন কিছুতেই হইতে চায় না। শেষটা যদুর রাগ হইয়া গেল। কিন্তু রাগের ভরে এক কাঠ ফেলিয়া দিয়া, ক্রমাগত আর দুই তিনটা কাঠ লইয়াও গামলা ছাড়া আর কিছু তয়ের করিতে পারিল না। যাহা হউক, গামলাগুলি হইল বাড়ি সরেস। সুতরাং সন্ধ্যার সময় যদুনাথ গোটা তিন চার গামলা ঘাড়ে করিয়া বাড়ি ফিরিল। এমন ভাল গামলাগুলি বনে ফেলিয়া আসিতে কিছুতেই তাহার ইচ্ছা হইল না।
তারপর গোষ্ঠ নৌকা গড়িতে চলিল, আর সেই একহাত লম্বা মানুষের অনুগ্রহে সন্ধ্যাবেলা পাঁচখানি অতিশয় উঁচুদরের লাঙল কাঁধে ঘরে ফিরিল।
অবশ্য, এরপর মানিক নৌকা গড়িতে গেল, আর তাহাকেও সেই একহাত লম্বা মানুষ আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি হচ্ছে?’ মানিক সাদাসিধা উত্তর দিল-‘জলে যেমন চলে ডাঙায়ও তেমনি চলে, এমন একখান নৌকা গড়ে দিতে পারলে, রাজামশাই বলেছেন, মেয়ে বিয়ে দেবেন।’ এই কথা শুনিয়া একহাত লম্বা মানুষ বলিল, ‘আচ্ছা, তাই হোক।’
মানিক সবে নৌকার কাঠ কাটিয়া সবে তাহাতে চড়িয়া বসিয়াছিল। একহাত লম্বা মানুষের কথা শেষ হইতে না হইতেই সেই কাঠ ছুটিয়া চলিয়াছে। সে আর এখন কাঠ নাই; অতি চমৎকার একখানা নৌকা। তাহাতে দাঁড়ি নাই, মাঝি নাই, দাঁড় নাই। যেখানে যাইবার দরকার, তাহা নিজেই বুঝিয়া লয়, সেখানে সে নিজেই থামে। রাজা-রাজড়ার উপযুক্ত মখমলের গদি তাকিয়ায় তাহার ভিতর সাজানো। বাহিরটা দেখিতে কি সুন্দর, তা কি বলিব। যে জিনিসে তাহা সাজাইয়াছে, তাহা সেই একহাত লম্বা মানুষের দেশে হয়। আমি তাহার নাম জানি না।
রাজামহাশয় সভায় বসিয়া আছেন, এমন সময় মানিকলালের নৌকা সেইখানে গিয়া উপস্থিত। সকলে নৌকার রূপগুণ দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল, আর কত প্রশংসা করিতে লাগিল। রাজামহাশয়ও খুব আশ্চর্য না হইয়াছিলেন এমন নয়। কিন্তু তাহা চাপিয়া গিয়া মুখে মানিককে বলিলেন, ‘এতেও হচ্ছে না; আর-একখানা কাজ করে দিতে হবে। একগাছ ঘ্যাঁঘাসুরের লেজের পালক হলে আমার মুকুটের শোভা হয়। এই জিনিসটি এনে দিলে নিশ্চয় আমার মেয়েকে বিয়ে করতে পাবে।’ মানিক ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া ঘ্যাঁঘাসুরের পালক আনিতে চলিল।
খানিকটা পাখি খানিকটা জানোয়ার, বিদ্ঘুটে চেহারা, খিটখিটে মেজাজ, ভারী জ্ঞানী, বেজায় ধনী, অসুর ঘ্যাঁঘা, এক মাসের পথ দূরে, অজানা নদীর ধারে, অচেনা শহরে সোনার পুরীতে বাস করেন। মানুষটিকে দেখতে পাইলেই রসগোলাটির মত টপ্ করিয়া তাহাকে গিলেন। সেই ঘ্যাঁঘা মহাশয়ের পালক আনিতে মানিক চলিয়াছে। যাহাকে দেখে, তাহাকেই ঘ্যাঁঘাসুরের মুলুকের পথ জিজ্ঞাসা করে; আর ডাইনে বাঁয়ে না চাহিয়া ক্রমাগত সেই পথে চলে। রাত্রি হইলে কাহারো বাড়িতে আশ্রয় লয়; আবার সকালে উঠিয়া চলিতে থাকে।