তারপর কয়েক মাস চ’লে গিয়েছে। গুপি আর বাঘা এখন হাল্লার রাজার বাড়িতে পরম সুখে বাস করে। দেশ বিদেশে তাদের নাম রটে গিয়েছে- ‘এমন ওস্তাদ আর কখনো হয় নি, হবেও না।’ রাজামশাই তাদের ভারি ভালোবাসেন; তাদের গান না শুনে একদিনও থাকতে পারেন না। নিজের দুঃখ সুখের কথা সব গুপির কাছে বলেন। একদিন গুপি দেখল, রাজামশায়ের মুখখানি বড়ই মলিন। তিনি ক্রমাগতই যেন কি ভাবছেন, যেনতাঁর কোনো বিপদ হয়েছে।শেষে একবার তিনি গুপিকে বললেন, ‘গুপি, মুশকিলে পড়েছি, কি হবে জানি না। শুণ্ডীর রাজা আমার রাজ্য কেড়ে নিতে আসছে।’
শুণ্ডীর রাজা হচ্ছেন সেই তিনি, যিনি গুপি আর বাঘাকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন্ তাঁর নাম শুনেই গুপির মনে একটা চমৎকার মতলব এল। সে তখন রাজামশাইকে বলল, ‘মহারাজ! এর জন্য কোন চিন্তা করবেন না। আপনার এই চাকরকে হুকুম দিন, আমি এ থেকে হাসির কাণ্ড ক’রে দেব। রাজা হেসে বললেন, ‘গুপি, তুমি গাইয়ে বাজিয়ে মানুষ, যুদ্ধের ধারও ধার না, তার কিছু বোঝও না। শুণ্ডীর রাজার বড় ভারি ফৌজ, আমি কি তার কিছু করতে পারি?’ গুপি বলল, ‘মহারাজ, হুকুম পেলে একবার চেষ্টা ক’রে দেখতে পারি। ক্ষতি ত কিছু হবে না।’ রাজা বললেন, ‘তোমার যা ইচ্ছা তাই তুমি করতে পার।’ এ খথায় গুপি যার পর নাই খুশি হয়ে বাঘাকে ডেকে পরামর্শ করতে লাগল।
গুপি আর বাঘা সেদিন অনেকক্ষণ ধরে পরামর্শ করেছিল্ বাঘার তখন কতই উৎসাহ! সে বলল, ‘দাদা, এবারে আমরা দুজনে মিলে একটা কিছু করবই করব। আমার শুধু এক কথায় একটু ভয় হচ্ছে। হঠাৎ যদি প্রাণ নিয়ে পালাবার দরকার হয়, তবে হয়ত আমি জুতোর কথা ভুলে গিয়ে সাধারণ লোকের মত কষে ছুট দিতে যাব, আর মার খেয়ে সারা হব। এমনি করে দেখ-না সেবারে আমাদের গাঁয়ে মূর্খগুলোর হাতে আমার কি দশা হ’ল!’
যা হোক, গুপি কথায় বাঘার সে ভয় কেটে গেল, আর পরদিন থেকেই তারা কাজে লাগল। দিনকতক ধরে রোজ রাত্রে তারা শুন্ডী চলে যায়, আর রাজবাড়ির আশেপাশে ঘুরে সেখানকার খবর নেয়। যুদ্ধের আয়োজন যা দেখতে পেল, সে বড়ই ভয়ঙ্কর। এ আয়োজন নিয়ে এরা হাল্লায় গিয়ে উপস্থিত হলে আর রক্ষা নেই। রাজার ঠাকরবাড়িতে রোজ মহাধুমধামে পুজো হচ্ছে। দশ দিন এমনিতর পুজো দিয়ে, ঠাকরকে খুশি ক’রে তারা হল্লায় রওনা হবে।
গুপি আর বাঘা এর সবই দেখল, তারপর একদিন তাদের ঘরে ব’সে,দরজা এঁটে,সেই ভুতের দেওয়া থলিটিকে বলল, ‘নতুন ধরনের মিঠাই চাই, খুব সরেস।’ সে কথায় থলির ভিতর থেকে মিঠাই যা বেরুল, সে আর বলবার নয়। তেমনি মিঠাই কেউ কায় নি, চোখেও দেখে নি। সেই মিঠাই নিয়ে বাঘা আর গুপি শুন্ডীর রাজার ঠাকুরবাড়ীর বিশাল মন্দিরের চূড়োয় গিয়ে বসল নীচে খুব পুজোর ধুম-ধূপধুনো শঙ্খঘন্টা কোলাহলের সীমা নেই, আঙিনায় লোকে লোকারণ্য। সেই সব লোকের মাথার উপরে ঝড়াৎ ক’রে মিঠাইগুলো ঢেলে দিয়ে বাঘা আর গুপি মন্দিরের ভিতর দিয়ে চুড়ো আঁকড়ে ধরে তামাশা দেখতে লাগল। অন্ধকারের মধ্যে সেই ধূপধূনা আর আলোর ধোঁয়ায় কেউ তাদের দেখতে পেল না।
মিঠাইগুলো আঙিনায় পড়তেই অমনি কোলাহল থেমে গেল। অনেকেই লাফিয়ে উঠল,কেউ কেই চেঁচিয়ে ছুটও দিল। তারপর দু-চার জন সাহসী লোক কয়েকটা মিঠাই তুলে, আলোর কাছে নিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখতে লাগল। শেষে তাদের একজন চোখ বুজে তার একটু মুখে পুরে দিল।
দিয়েই আর কথাবার্তা নেই-সে দুহাতে আঙিনা থেকে মিঠাই তুলে খালি মুখে দিচ্ছে আর নাচছে আর আহাদে চেঁচাচ্ছে। তখন সেই আঙিনা-সুদ্ধ লোক মিঠাই খাবার জন্য পাগলের মত কাড়াকাড়ি আর কিচিরমিচির করতে লাগল।
এদিকে কয়েকজন ছুটে গিয়ে রাজামশাইকে বলছে, ‘মহারাজ! ঠাকুর আজ পুজোয় তুষ্ট হয়ে স্বর্গ থেকে প্রসাদ পাঠিয়ে দিয়েছেন। সে যে কি অপূর্ব প্রসাদ, সে কথা আমরা বলতেই পারছি না।’ সে কথা শুনবামাত্রই রাজামশাই প্রাণপণে কাছা গুঁজতে গুঁজতে ঊর্ধ্বশ্বাসে এস ঠাকুরবাড়িতে উপস্থিত হলেন।
কিন্তু হায়! ততক্ষণে সব প্রসাদ শেষ হযে গিয়েছিল্ সমস্ত উঠোন ঝাঁট দিয়েও রাজামশাইয়ের জন্য একটু প্রসাদের গুঁড়ো পাওয়া গেল না। তখনি তিনি ভারি চটে গিয়ে বললেন, ‘তোমাদের কি অন্যায়। পুজো করি আমি,আর প্রসাদ খেয়ে শেষ কর তোমরা! আমার জন্যে একটু গুঁড়োও রাখ না! তোমাদের সকলকে ধ’রে শুলে চড়াব।’ এ কথায় সকলে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জোড়াহাতে বলল, ‘দোহাই মাহরাজ! আপনার প্রসাদ কি আমরা খেয়ে শেষ করতে পারি? বাপ্ রে! আমরা খেতে না খেতেই ঝাঁ করে কোনখান দিয়ে ফুরিয়ে গেল।! আজ আমাদের প্রসাদগুলো আপনি মাপ করুন; কালতকের যত প্রসাদ, সব মহারাজ একাই খাবেন।’ রাজা তাতে বললেন, ‘আচ্ছা তাই হবে। খবরদার ! মনে তাকে যেন।’
পরদিন রাজামশাই প্রসাদ খাবেন, তাই একপ্রহর বেলা থাকতেই তিনি ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় এসে আকাশের পানে তাকিয়ে বসে আছেন। আর সকলে ভযে ভয়ে একটু দূরে বসে তাঁকে ঘিরে তামাশা দেখছে। আজ পুজোর ঘটা অন্যদিনের চেয়ে শতগুণ্ সবাই ভাবছে, দেবতা তাতে খুশি হয়ে রাজামশাইকে আরো ভাল প্রসাদ দেবেন।
রাত-দুপুরের সময় গুপি আর বাঘা আরো আশ্চর্যরকমের মিঠাই নিয়ে এসে মন্দিরের চুড়োয় বসল। আজ তাদের পরনে খুব জমকালো পোশাক, মাথায় মুকুট, গলায় হার, হাতে বালা, কানে কুণ্ডল। তারা দেবতা সেজে এসেছে। ধোঁয়ার জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তবু রাজামশাই আকাশের পানে তাকিয়ে আছেন। এমন সময় গুপি আর বাঘা হাসতে হাসতে তাঁর উপরে সেই মিঠাইগুলো ফেলে দিল। তাতে রাজামশাই প্রথমে একটা চিৎকার দিয়ে তিন হাত লাফিয়ে উঠলেন, তারপর তাড়াতাড়ি সামলিয়ে নিয়ে,হাতে মিঠাই তুলে মুখে দিতে লাগলেন, আর ধেই ধেই ক’রে নাচনটা যে নাচলেন!