মহিলাদের দেখে আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। রেহনুমা থাকলে এইভাবে বাপ্পার অপেক্ষায় থাকত, বাপ্পার জন্যে আমার টেনশন থাকত না। হায়রে জীবন।
ড্রাইভার গাড়ি থামিয়েছে স্কুলের বেশ দূরে। মিনিটখানেকের পথ। দেখে আমি বললাম, তুমি বাপ্পাকে ডেকে আন। আমি এখানে দাঁড়াই।
আমি তারপর গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়াই। দাঁড়িয়ে উদাস ভঙ্গিতে সিগ্রেট টানতে থাকি।
মিনিট দশেক পর বাপ্পা আসে। দূর থেকে আমি বাপ্পাকে দেখি, পরনে সাদা হাফহাতা শার্ট নীল হাফপ্যান্ট, পায়ে লম্বা সাদা মোজা হাঁটু অব্দি। আর কেডস। বাপ্পার পিঠে স্কুলের ব্যাগ। গাড়ির সামনে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দূর থেকে বাপ্পা চেঁচিয়ে ডাকে, পাপা। তারপর ড্রাইভারের হাত ছাড়িয়ে ছুটতে থাকে।
আমি দুহাত বাপ্পার দিকে বাড়িয়ে দিই। সন্তান, আমার সন্তান।
বাপ্পা ছুটে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে।
বাপ্পাকে নিয়ে আমি তারপর সোজা বাড়ি চলে আসি। অফিসে টেলিফোন করে বলে দিই, আমি আজ আর অফিসে যাব না।
বিকেলবেলা বাপ্পা আর আমি বাগানে ঘুরে বেড়াই। বাপ্পার হাতে ছিল হলুদ রাবারের বল; থেকে থেকে লাথি মারছিল সে। তারপর ছুটে গিয়ে নিজেই কুড়িয়ে আনছিল বলটা। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে বাপ্পাকে দেখি। উদাস ভঙ্গিতে বাগানময় পায়চারি করি, সিগ্রেট টানি। বাগানটা ফুলে ফুলে ভরে গেছে। হাওয়ায় কত রকমের যে গন্ধ! বিকেলের কোমল রোদ পড়েছিল ঘের দেয়া গোলাপ বনে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে কোমল রোদে গোলাপ দেখি। স্বপ্নের মতো ফুটে আছে। আর প্রজাপতিগুলো হেলিকপ্টারের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে চারপাশে। দেখে আমার রেহনুমার কথা মনে পড়ে। চলে গিয়েও রেহনুমা আমার সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকল। ছেড়েও ছাড়ল না। নয়তো আমার পক্ষে দ্বিতীয় বিয়ে করা সম্ভব ছিল। বাপ্পাকে দেখেও অনেকে রাজি হত। আমি প্রতিষ্ঠিত একজন লোক। বাড়ি, গাড়ি বিজনেস। কোনও পিছুটান নেই। শুধু বাপ্পা। তবুও বিয়ে করতে আমার আটকাত না। দু একবার ভেবেছিলাম। এগুইনি ভয়ে। আবার যদি নতুন করে কোনও সমস্যা তৈরি হয়। কিংবা দ্বিতীয়জনও এসে যদি বাপ্পাকে অবহেলা করে।
এসব ভাবছি, ঠিক তখুনি বাপ্পা চেঁচিয়ে ওঠে, পাপা, পাপা সাপ।
শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথা ঘুরে যায়। কিছু মনে থাকে না। পাগলের মতো ছুটে যাই বাপ্পার কাছে। কোথায়, কোথায় সাপ?
বলটা দু’হাতে বুকে জড়িয়ে বাপ্পা দাঁড়িয়েছিল বাগানের শেষপ্রান্তে। হাসনুহেনা ঝোঁপের কাছে। হানুহেনা ঝোঁপটা বিশাল হয়ে উঠেছে কোন ফাঁকে আমি কখনও খেয়াল করিনি। বিকেলবেলাই আবছা অন্ধকার জমে গেছে ঝোঁপের তলায়। ঝিঝি ডাকছে। আমি ওসব খেয়াল না করে বাপ্পাকে জড়িয়ে ধরি। কোথায় সাপ?
বাপ্পা আঙুল তুলে ঝোঁপের তলাটা দেখায়। সেখানে পড়েছিল, একটা সাপের খোলস। একটা সাপ আছে বাগানে। খোলস পাল্টেছে। দেখে আমি চমকে উঠি। বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। আমার সাজানো বাগানে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে আততায়ী সাপ! বাপ্পা যখন তখন বাগানে আসে। বাপ্পাকে যদি দংশায়।
আমি আর ভাবতে পারি না। দুহাতে পাগলের মতো বাপ্পাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। তারপর বাগান ভেঙে ছুটতে থাকি। বাপ্পাকে নিয়ে বহুদূরে চলে যাব আমি, সম্পূর্ণ নিরাপদ কোনও জায়গায়। যেখানে অশুভ কোনও ছায়া বাপ্পাকে স্পর্শ করতে পারবে না।