কোথায়?
আপাতত আমাদের বাসায় থাকব কিছুদিন। তারপর দেখব, কী করা যায়।
আমি আর কথা বলিনি। পরদিন সকালবেলা রেহনুমা তার সুটকেস ইত্যাদি নিয়ে চলে গেল। এসবের দিন পনের পর এল ডিভোর্স লেটার।
তারপর থেকে আমার একলা জীবন। অফিস আর বাড়ি। ব্যবসা আর বাপ্পা। সকালবেলাটা কাটাই বাপ্পার সঙ্গে, বিকেলবেলাটা কাটাই বাগানে। বিকেলে বাপ্পার হাত ধরে বাগানে বেড়াতে বেড়াতে আমার খুব রেহনুমার কথা মনে পড়ে। বাপ্পা ছুটোছুটি করে বাগানে আর আমি বেঞ্চে বসে উদাস হয়ে সিগ্রেট টানি।
রেহনুমা চলে যাওয়ার পর আমি আবার বাগান ভেঙে চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি করতে চেয়েছিলাম। বাপ্পার কথা ভেবে করা হয়নি। বাগানটা বাপ্পার খেলার জায়গা হয়ে উঠেছে। বিকেলবেলা আজকাল রাবারের বল নিয়ে বাপ্পা বাগানে যায়। ধাম ধাম বলে লাথি মারে। আমাকে দেয়। পাপা, তুমিও খেল। আমি সব ভুলে বাপ্পার বয়সী খেলোয়াড় হয়ে যাই।
রেহনুমা এখন ব্যাংককে আছে। ব্যাংককে সেটেল এক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে চলে গেছে। লোকটা শুনেছি ইমপোর্টেন্ট। রেহনুমার কোনও ছেলেমেয়ে হয়নি। মাস ছয়েক ধরে রেহনুমা আমাকে চিঠি লিখছে, বাপ্পাকে আমি চাই। আমি বাপ্পাকে আমার কাছে নিয়ে আসব। তুমি না দিলে জোর করে আনব। আমার অনেক লোকজন আছে। তোমাদের আশেপাশে। প্রয়োজন হলে চুরি করে আনব বাপ্পাকে।
ফলে আমি সারাক্ষণ একটা ভয়ের মধ্যে থাকি আজকাল। বাপ্পাকে চোখে চোখে রাখি। স্কুলে পাঠিয়ে স্বস্তি পাই না। এমনিতেই প্রচুর শিশু চুরি যাচ্ছে শহর থেকে। সে এক ভয়। আরেক ভয় রেহনুমা। আমার আশে-পাশে নাকি তার মালা লোকজন রয়েছে। সত্যি সত্যি বাপ্পাকে যদি সে চুরি করে নিয়ে যায়! গড, আমি তাহলে পাগল হয়ে যাব।
সকালবেলা হায়াত এল পৌনে দশটার দিকে। আমি তখন কী একটা ফাইল দেখছি। হাতে সিগ্রেট জ্বলে যাচ্ছে, সামনে চায়ের কাপ। দু-এক চুমুক দেয়া হয়েছে।
রুমে ঢুকেই হায়াত বলল, সরি দেরি হয়ে গেছে, তোর ঘ রেডি? আমি ফাইলের ভেতর এতটা ডুবেছিলাম, খানিক কিছু বুঝতে পারি না। অবাক হয়ে বলি, কী?
ড্রাফট তিনটে করিয়েছিস?
ও।
গতকালই হায়াতের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। হায়াত আজ এক জায়গায় টেন্ডার দেবে। নেগোসিয়েশান করেছে। কেউ টেন্ডার দেবে না। আটজন কন্ট্রাক্টর শিডিউল কিনেছিল। প্রত্যেককে পনের হাজার করে দিয়ে শিডিউলগুলো নিয়ে নিয়েছে হায়াত। এখন আর্নেস্টমানি নেই। ড্রাফট করাতে হবে তিনটে। লাখ দুয়েক টাকার ব্যাপার। কাল বিকেলে হায়াত এসেছিল আমার কাছে। তুই ড্রাফটগুলো করিয়ে দে।
আমি ব্যবসায়ী মানুষ। বললাম, কাজটায় আমাকে শেয়ার রাখ!
হায়াত খুশি হয়ে বলল, গুড প্রোপোজাল। চল। এত বড় কাজ আমার পক্ষে তো করা কঠিন। পার্টনার তো নিতেই হতো। তুই থাকলে ভাল হয়।
তারপরও হায়াতের সঙ্গে বহুক্ষণ ধরে কাজটার ব্যাপারে কথা হয়েছে। আমি আর্নেস্টমানি দেব এবং কাজ করতে যা লাগে তার ফিফটি পার্সেন্ট দেব। প্রফিট ফিফটি ফিফটি। আজ সকালের মধ্যে হায়াতকে নিটে ড্রাফট করিয়ে দেব কথা হয়েছিল। এখন অবাক লাগছে, ভুলে গিয়েছিলাম কেন! সকালবেলা এসেই তো অ্যাকাউনট্যান্ট সাহেবকে ব্যাংকে পাঠাবার কথা।
হায়াতকে দেখে আমার সব মনে পড়ে। বেল টিপে পিয়নকে বলি, তাড়াতাড়ি অ্যাকাউনট্যান্ট সাহেবকে ডাক। আর এখানে এক কাপ চা দাও।
হায়াত বলল, এখনও ব্যাংকে পাঠাসনি! এগারটার মধ্যে আমাকে ড্রাফট নিয়ে পৌঁছুতে হবে।
হয়ে যাবে। তুই বোস। অ্যাকাউনট্যান্ট সাহেব তোর সঙ্গে যাবে। মিনিট দশেক লাগবে ড্রাফট করাতে।
কিন্তু পিয়নটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে আমি খুব রেগে যাই। ডাকলি না?
যুবক পিয়ন কাঁচুমাচু গলায় বলল, স্যার অ্যাকাউনট্যান্ট সাহেব তো অফিসে আসে নাই।
কেন?
তার ছোড পোলাড়া বলে হারাইয়া গেছে।
শুনে আমি আপাদমস্তক চমকে উঠি। মুহূর্তে বাপ্পার কথা মনে পড়ে আমার। উদ্ভ্রান্তের মতো জিজ্ঞেস করি, কবে হারাল? কীভাবে?
কাইল বিকালে হারাইছে। চাইর পাঁচ বছরের পোলা। বাড়ির সামনের মাঠে খেলতে গেছিল।
অ্যাকাউনট্যান্ট সাব বাড়িতে গিয়া দ্যাহে বোকতে কানতাছে। সকালবেলা হেয় লোক পাডাইয়াছিল। আইজ অফিসে আইব না।
আমার কানে এসব কথা ঢোকে না। পিয়নকে বললাম, মাসুম সাহেবকে পাঠা। মাসুম সাহেব অ্যাকাউন্টস অ্যাসিসট্যান্ট। তাকে দুলাখ টাকার চেক দিয়ে বললাম, হায়াত সাহেবের সঙ্গে যাও। তিনটি ড্রাফট করে দেবে।
হায়াতকে বললাম, তুই কাল আসিস হায়াত। আমি এখন একটু বেরুব।
আমি তারপর গাড়ি নিয়ে সোজা বাপ্পার স্কুলে। আমার তখন অন্যকিছু খেয়াল ছিল না। শহরে শিশু চুরি বেড়ে গেছে। তার ওপর বাপ্পাকে নিয়ে আছে রেহনুমার ব্যাপার। দূরে থেকে, ইমপোর্টেন্ট স্বামী দেখে রেহনুমা এখন সন্তানের ব্যাপারে সিরিয়াস। বলেছে, তার ম্যালা লোক ছায়ার মতো ঘুরছে বাপ্পার চারপাশে। আমি রাজি হলে বাপ্পাকে সে চুরি করে নিয়ে যাবে।
গাড়িতে বসে আমি মনে মনে রেহনুমার উদ্দেশে বলি, পারবে না, বাপ্পাকে তুমি আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। আমি বাপ্পাকে বুক দিয়ে আগলে রাখব।
.
বাপ্পার স্কুলের সামনে ম্যালা ভিড়। অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিছু রিকশা আছে, হোন্ডা আছে। আর আছে মহিলারা। সন্তানের অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সন্তান স্কুল থেকে বেরুলে তাকে নিয়ে বাড়ি যাবে।