রেহনুমা বলল, তোমার চালাকি আমি বুঝি। তুমি আমাকে ঘরে আটকে রাখতে চাও। বাচ্চা হলে বন্ধুবান্ধবরা আগের মতো ভিড়তে পারবে না। হৈ-হল্লা করতে পারবে না।
আমি হেসে বলেছিলাম, এসব ছেলেমানুষি কথা। বাচ্চা হলেই কি মানুষের জীবন পাল্টে যায়। তুমি তোমার ইচ্ছে মতোই চলতে পারবে।
রেহনুমা তারপর খুব কান্নাকাটি করেছিল। আমি চাই না, আমি চাই না। এটা হবে আনওয়ান্টেড চাইল্ড। এই বাচ্চার জন্যে আমার ভালবাসা থাকবে না।
আমি কোনও কথা বলিনি।
মাস তিনেকের মাথায় একরাতে কোনও এক পার্টি থেকে মাতাল হয়ে ফিরল রেহনুমা। আমি আর পারছি না। অসম্ভব। আমি ডাক্তারের কাছে যাব। এবরসন করাব। শুনে আমার যে,কী হলো, হঠাৎ দু’হাতে অবিরাম চড় মারতে লাগলাম রেহনুমাকে। প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রেহনুমা। নেশা কেটে গেল। তারপর বিছানায় পড়ে বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদতে লাগল।
সেই রাতে আমরা দু’জন দু’খাটে ঘুমিয়েছিলাম।
পরদিন থেকে রেহনুমার আচার আচরণ পাল্টে গেল। হঠাৎ বড় চুপচাপ হয়ে গেল। আমার সঙ্গে কথা বলে কম। বাড়ির চাকরবাকরকে আগে খুব ধমাধমকি করত, সেটা বন্ধ হয়ে গেল এবং বন্ধুবান্ধবদের আনাগোনা গেল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে। সারাদিন বাড়িতে বসে থাকে। বিকেলবেলা বাগানে ঘুরে বেড়ায়। গাছপালার তদারকি করে। দেখে আমি ভাবলাম, যাক বন্ধুবান্ধব বাদ দিয়ে রেহনুমা যদি বাগানটা নিয়ে আবার মেতে ওঠে তাহলে বেশ হয়। বাগানে নতুন ফুল ফোঁটানোর ব্যাপারে রেহনুমা যদি ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়ে তাহলে হয়তো বা পেটের সন্তানের প্রতিও ভালবাসা জন্মাবে। বাগানে ফুল ফোঁটানো আর সন্তান জন্ম দেয়া তো একই ব্যাপার।
বাপ্পা হওয়ার মাসখানেক আগে রেহনুমা চলে গেল বাপের বাড়ি। এই সময় মেয়েরা নাকি বাপের বাড়ি থাকে। আমি রেহনুমাকে প্রতিদিন দেখতে যাই। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ওষুধপথ্য পৌঁছে দিয়ে আসি। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করে অবাক হই। রেহনুমা আগের মতো উচ্ছল গলায় আমার সঙ্গে কথা বলে না। কেমন বিষণ্ণ হয়ে থাকে। ব্যাপারটা খেয়াল করে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি জোর করে বাচ্চা দিয়ে রেহনুমার অন্য কোথাও ক্ষতি করছি না তো!
কিন্তু তখন আর সময় নেই। কিছু করার উপায় নেই।
অভিজাত একটা নার্সিংহোমে বাপ্পা জন্মাল। ওজন সাত পাউন্ড চার আউন্স। নার্সিংহোমে বাপ্পার মুখ দেখে আমার পৃথিবী খুব সুন্দর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রেহনুমার মুখ দেখে মনটা গিয়েছিল খারাপ হয়ে। রেহনুমা কেমন উদাস, কেমন বিষণ্ণ।
সাতদিনের মাথায় রেহনুমাকে বাড়ি নিয়ে এলাম। বাড়ি এসেই রেহনুমা বলল, বাচ্চার জন্যে আয়া রাখ। আমার পক্ষে বাচ্চার প্রতিপালন সম্ভব নয়। অত কিছু আমি পারব না। দুদিন পর এই আয়াকে আমি ঠিক করলাম। নিঃসন্তান, মধ্যবয়স্কা ভদ্রমহিলা। এই বাড়িতে ঢুকেই বাপ্পাকে বুকে তুলে নিল। আজও বাপ্পা তার বুকেই আছে। মায়ের মতো বুক দিয়ে বাপ্পাকে আগলে রেখেছে সে।
বাপ্পার জন্মের পরও আড়াই বছর একত্রে থেকেছি আমরা। তারপরই ঘটে গেল সেই অমোঘ ব্যাপারটা। নিয়তি এ রকমই ছিল।
জন্মের সাতদিন পরই বাপ্পা চলে গিয়েছিল আয়ার হাতে। তার ঘরেই বাপ্পাকে ঘের দেয়া ছোট্ট খাট দোলনা। দুধ, ফিডার, জামা কাপড় ধ্ব। দিনরাত মহিলা আছে বাপ্পার সঙ্গে সঙ্গে। মায়ের মতো আদরযত্নে সে প্রতিপালন করতে লাগল বাপ্পাকে। রেহনুমা দিনে একবারও বাচ্চাটি ছুঁয়ে দেখে না। কান্নাকাটি করলেও বুকে তুলে নেয় না। তুমি কেমন মা হলে, নিজের সন্তানকে কোনও মেয়ে অবহেলা করে, এরকম কথা তো গল্প উপন্যাসেও পড়িনি।
মনে আছে, তখন বিকেলবেলা। বাপ্পাকে প্যারামবুলেটরে চড়িয়ে আয়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল বাগানে। রেহনুমা সেদিকে তাকিয়ে বলল, মনেই হয় না বাচ্চাটা আমার। তুমি জোর করে আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছ। আনওয়ান্টেড চাইল্ড। কথাটা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে আমার। স্পর্শ করলে মনে হয় এ অন্যের সন্তান।
আমার আর কিছু বলার ছিল না। সারা বিকেল মন খারাপ হয়ে থাকে। একের পর এক সিগ্রেট খাই। এ আমি কী করলাম। বাপ্পার জীবনটা বিষাক্ত করে ফেললাম। বাপ্পা যদি বড় হয়ে এ ব্যাপারে আমাকে অভিযুক্ত করে।
এই অপরাধবোধ থেকেই বাপ্পাকে আমি মায়ের মতো কাছে টেনে নিলাম। আমি যতক্ষণ বাড়ি থাকি, বাপ্পা আমার কাছে থাকে। বিকেলবেলা প্যারামবুলেটরে চড়িয়ে বাপ্পাকে নিয়ে আমিই বাগানে ঘুরে বেড়াই। রেহনুমা সাজগোজ করে বেরিয়ে যায়। কোথায় যায় কে জানে। ফেরে অনেকটা রাত করে। মাতাল হয়ে।
এই বাড়িতে ঢুকেই ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছিল আয়া। থাকাখাওয়া বাদে মাসে মাইনে দেড়শো টাকা তার। এ ছাড়া অন্য কোনও ব্যাপারে নাক গলায়নি সে। মহিলার সিনসিয়ারিটি দেখে ক্রমান্বয়ে আমি তার মাইনে বাড়িয়েছি। এখন চারশো টাকা।
তবুও রেহনুমা থাকল না। বাপ্পার যখন আড়াই বছর বয়স, যখন সারাবাড়ি ছুটোছুটি করে বাপ্পা, বিকেলে আয়ার সঙ্গে বাগান চষে ফেরে, তখন এক রাতে রেহনুমা বলল, আমি কাল চলে যাচ্ছি।
বাপ্পার জন্মের পর থেকেই আমরা দুজন আলাদা রুমে থাকি। আমি বাপ্পাকে নিয়ে মেতে থাকি, আর রেহনুমা তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে। পাশাপাশি থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা জীবন আমাদের। বুও আমি কখনও ভাবিনি রেহনুমা চলে যাবে কিংবা চলে যেতে পারে। শুনে চমকে উঠেছিলাম।