মনে আছে, সেই বিকেলে রেহনুমা পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে প্ল্যান করেছিল, কোথায় গ্যারেজ হবে, খালি জায়গাটা সম্পূর্ণ তাকে দিয়ে দিতে হবে। সে তার ইচ্ছেমতো বাগান করবে। আমি বলেছিলাম, যাও, দিয়ে দিলাম।
শুনে রেহনুমা যে কী খুশি! বলেছিল, তুমি খুব ভাল। খুব ভাল।
আজকাল মনে হয়, আমি আসলেই খুব ভাল। নয়তো রেহনুমা চলে যায় কেমন করে! আমি তাকে চলে যেতে দিলাম কেমন করে।
এই বাড়িতে এসে ওঠার পর, মাস তিনেক যেতে না যেতেই বাড়িটার চেহারা পাল্টে গেল। রেহনুমার ইচ্ছেমতো গ্যারেজ হলো, সার্ভেন্ট কোয়ার্টার হলো, বাড়ির পেছনটায়। আর সবচে যত্নে, ম্যালা টাকা খরচ করে যে জিনিসটা হলো সেটা এই বাগান। কী রকম যে মেতে উঠেছিল রেহনুমা এই বাগান করতে। প্রতিদিন অফিসে গিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে হত আমায়। গাড়ি নিয়ে রেহনুমা যেত শহরের নামকরা নার্সারিগুলোতে। আজ অমুক গাছের চারা আনছে, কাল অমুক ফুলের বীজ। বছর ঘুরতে না ঘুরতে বাগানটার চেহারা গেল চমৎকার হয়ে। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা আমার খুব ভাল লাগেনি। ব্যবসায়ী মানুষ তো, গাছপালার পেছনে এত টাকা ব্যয় হচ্ছে দেখে, গোপনে গোপনে বুকে বড় ব্যথা পেতাম। আর এলাকাটা আস্তেধীরে মূল্যবান হয়ে যাচ্ছিল দেখে আমার মাথায় একটা ব্যবসায়ী বুদ্ধিও খেলেছিল। বাড়িটার মাঝামাঝি দেয়াল তুলে অপরাংশে আর একটা চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ি করে ভাড়া দেব। কিন্তু রেহনুমাকে সে কথা বলার সাহস ছিল না। রেহনুমাকে আমি খুব ভালবাসতাম। বড় ভয় পেতাম। ভালবাসার মানুষকে কে না ভয় পায়।
রেহনুমা খুব সুন্দর ছিল।
বাগানটা যখন ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল, গাছপালায় ঝোঁপঝাড়ে যখন পরিপূর্ণ হয়ে উঠল, যখন দিনমান বাগানের ভেতর খেলা করতে লাগল মিঠেল ছায়া, উড়তে লাগল প্রজাপতি, দিনেদুপুরে ডাকতে শুরু করল ঝিঝি পোকা, পাখপাখালি, তখন বাগানের দিকে তাকিয়ে আমার বেশ লাগত। রেহনুমাকে মুগ্ধ গলায় প্রায়ই বলতাম, চমৎকার একটা কাজ করেছ।
রেহনুমা বলত, আমার ছেলেবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল মনের মতো একটি বাগান করব। আমাদের বাড়িতে জায়গা ছিল না বলে করা হয়নি। তবুও আমার ঘরে ছিল মানিপ্লান্ট, ব্যালকনির টবে ছিল গোলাপ চারা। স্কুলের টিফিনের পয়সা কলেজ ইউনিভার্সিটি খরচ বাঁচিয়ে এসব করতাম আমি।
শুনে আমি একদিন ঠাট্টা করে বলেছিলাম, পরীক্ষার খাতায় তুমি তাহলে একটি রচনাই লিখেছ সবসময়। আমার বাগান।
রেহনুমা খুব হেসেছিল সেদিন।
আমাদের বিয়ের দুবছর পর বাপ্পা হলো। বাপ্পার জন্ম নিয়েই রেহনুমার সঙ্গে আমার প্রথম লেগেছিল। রেহনুমা চায়নি এত তাড়াতাড়ি আমাদের সন্তান হোক। বিয়ের অন্তত পাঁচ বছর পর প্রথম সন্তান হবে। রেহনুমা এরকম ভেবে রেখেছিল। এই পাঁচটা বছর উদ্দাম জীবনযাপন করবে। মধ্যবিত্ত ঘরের ইউনিভার্সিটি পড়া মেয়ে রেহনুমা। স্বামীর প্রচুর টাকাপয়সা, গাড়িবাড়ি এসব দেখে রেহনুমার প্রচুর বন্ধুবান্ধব জুটেছিল। তাদের নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করতে রেহনুমা খুব পছন্দ করত। পিকনিকে যাও, সি বিচে চল পনের দিনের জন্যে, বছরে দু’বার অযথা বিদেশ বেড়াতে যাওয়া, এই করে করে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।
আমি একটু একাচোরা স্বভাবের মানুষ। নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করি। রেহনুমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে আমার আপত্তি ছিল না। আপত্তি কেবল ওইসব দলবলের। লোকগুলোকে, মেয়েমানুষগুলোকে আমার পছন্দ হত না। জোর করে প্রথমে কিছুদিন মেশার চেষ্টা করেছিলাম। নিজের বিরুদ্ধে কাঁহাতক যুদ্ধ করা সম্ভব! পরে নিঃশব্দে সরে গেছি। রেহনুমা একা একাই ওদের সঙ্গে চলাফেরা করত। গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে চলে যেত, পিকনিকে যেত। আর যেদিন বাইরে কোনও প্রোগ্রাম না থাকত সেদিন বিকেলে সবগুলো এসে জুটত বাড়িতে। বাগানে চেয়ারটেবিল পাতা ছিল। সেখানে বসে বিকেলবেলা কী হইচই। চাকফি খাওয়া। কোনও কোনও দিন ডিনার। ডিনারের আগে ড্রিংকস। বাড়ির দুনম্বর ফ্রিজটা ভরা থাকত ড্রিংসে। ব্যাপারটা আমার একদমই পছন্দ ছিল না। দুচার বার আপত্তি করেছি। রেহনুমা পাত্তা দেয়নি। পরে এই সবের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে ভেবেছি, বাগানের এলাকাটিতে চারতলা ফ্ল্যাটটা করে ফেলব। রেহনুমাকে একদিন বললাম। শুনে সে কী রাগ তার! তুমি একটা ইডিয়ট। অত সুন্দর বাগান কেউ নষ্ট করে। আমি এত কষ্ট করে করলাম। সবকিছু নিয়ে তুমি ব্যবসা করতে চাও কেন?
জবাব দেয়া হয়নি। ভয়ে এবং ভালবাসায়।
পরে ভাবলাম, রেহনুমাকে একটা সন্তান দেওয়া উচিত। বাচ্চাকাচ্চা হলে এইসব ব্যাপার আপসে কেটে যাবে। বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনও মেয়ে অন্যকিছু ভাবতে পারে না। কিন্তু এই কথাটা রেহনুমাকে আমি লুকিয়ে গেলাম। গোপনে একদিন ঘটে গেল ব্যাপারটা। দেখে আমি গোপনে শ্বাস ফেলে বাঁচি। যাক। একটা উপায় হল এবার।
কিন্তু মাসখানেকের মাথায় শুরু হলো রেহনুমার রিয়্যাকশান। আমি ডাক্তারের কাছে যাব। এত তাড়াতাড়ি ওসব ঝামেলা আমার পোষাবে না। তুমি ইচ্ছে করে এমন করেছ। চাও না আমি ফ্রি থাকি।
আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, এই প্রথম শুনলাম কোনও মেয়ে সন্তান চায় না। সাধারণত পুরুষ মানুষরা চায় সন্তান দেরি করে আসুক। মেয়েরাই জোর করে আগে নেয়। তোমার দেখছি সম্পূর্ণ উল্টো। ঠিক আছে একটা বাচ্চা হোক, পরে না হয় আর না হবে।