- বইয়ের নামঃ ফুলের বাগানে সাপ
- লেখকের নামঃ ইমদাদুল হক মিলন
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
ফুলের বাগানে সাপ – ইমদাদুল হক মিলন
শহরে শিশুচুরি হঠাৎ খুব বেড়ে গেল। প্রথমদিকে মাসে দু একটি শিশুচুরির কথা খবরের কাগজের মাঝের পাতায় ছাপা হত। ইদানিং প্রথম পাতায় ফলাও করে ছাপা হয়। নার্সিংহোম থেকে, হাসপাতাল থেকে সদ্যজাত শিশু উধাও হয়ে যাচ্ছে। একই হেডিঙের তলায় চার পাঁচ কিংবা আট নটি শিশু চুরি যাওয়ার খবর ছাপা হচ্ছে। একেক দিন। প্রথমদিকে শুধুমাত্র সদ্যজাত শিশুই চুরি হত। কদিন ধরে চার-পাঁচ বছর বয়সের শিশুও হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে, হাসপাতাল থেকে, রাস্তাঘাট থেকে। ফলে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। একজনও শিশুচোর ধরা পড়ছে না।
এইসব শিশুরা যাচ্ছে কোথায়?
দু-তিনদিন আগে একটি খবরের কাগজে পোস্ট এডিটরিয়াল বেরিয়েছে শিশুচুরি নিয়ে। পত্রিকাটি বলেছে, শিশু চুরির পেছনে নিশ্চয় বড় রকমের কোনও সংঘবদ্ধ দল কাজ করে যাচ্ছে। দলটির পেছনে বিদেশি শক্তির প্রভাব থাকাও বিচিত্র নয়। কারণ, যেসব শিশু চুরি যাচ্ছে, পত্রিকাটির অভিমত, সেইসব শিশুর বেশির ভাগই পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা এবং স্ক্যান্ডেনেভিয়ান। কান্ট্রিগুলোয় নিঃসন্তান দম্পতির সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। সেসব দেশের দম্পতিরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে শিশু ক্রয়ের দিকে ঝুঁকেছে। ফলে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো থেকে প্রচুর শিশু উধাও হয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে কাজ করছে অত্যন্ত ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী এবং সংঘবদ্ধ একটি দল। তৃতীয় বিশ্বের বেশকিছু দেশে যাদের এজেন্ট রয়েছে। সম্প্রতি বহির্বিশ্বের কয়েকটি দেশে তৃতীয় বিশ্বের শিশু প্রতিপালিত হচ্ছে এ ধরনের সংবাদ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রিকায় ছবিসহ ছাপা হতে দেখা গেছে।
পোস্ট এডিটরিয়ালটা পড়ার পর থেকে বাপ্পাকে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে। বাপ্পা আমার একমাত্র সন্তান। চার বছর বয়স। এ বছরেই বাপ্পাকে আমি শহরের একটি অভিজাত কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করিয়েছি। ফলে বাপ্পাকে নিয়ে আমার একটা বাড়তি উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। ভোরবেলা বাপ্পাকে স্কুলে পৌঁছে দেয়া, এগারটার সময় অফিস থেকে গাড়ি পাঠিয়ে বাপ্পাকে বাড়ি নেয়া।
বাপ্পাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে প্রথম দুটো কাজই আমাকে করতে হত। ভোরবেলা। উঠে বাপ্পাকে সাজগোজ করিয়ে দিত আয়া। আমি নিজে ড্রাইভ করে বাপ্পাকে নিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসতাম বাড়ি। বাপ্পাটা আমাকে ছাড়া নড়তেই চাইত না। কান্নাকাটি জুড়ে দিত। আস্তে ধীরে বাপ্পার সেই অভ্যেসটা পাল্টেছে। আজকাল ভোরবেলা আয়া বাপ্পাকে সাজগোজ করিয়ে, কাঁধে ব্যাগ দিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। ড্রাইভার স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসে। এগারটার সময় গিয়ে নিয়ে আসে। তোরবেলা স্কুলে যাওয়ার সময় বাপ্পার ঘুম ভেঙে যায়। এসে টুক করে আমার গালে একটা চুমু খায়। আমি স্কুলে যাচ্ছি পাপা।
আর আমার যেদিন ঘুম ভাঙে না, সেদিন বাপ্পা এসে আমাকে ডেকে তোলে তারপর চুমু খেয়ে স্কুলে চলে যায়। তারপর হাজার চেষ্টা করলেও আমি আর ঘুমুতে পারি না। আমার খুব রেহনুমার কথা মনে পড়ে। রেহনুমা থাকলে বাপ্পাকে নিয়ে আমার কোনও উৎকণ্ঠা থাকত না। রেহনুমা কেন যে অমন করে চলে গেল!
সকালবেলা বাপ্পা যাওয়ার পর আমার বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিছু করার থাকে। বিছানায় শুয়ে পরপর দুকাপ চা খাই। খবরের কাগজ পড়ি। তারপর উঠে বারান্দায় গিয়ে অকারণে বাগানটার দিকে তাকিয়ে থাকি। এক বিঘে জমির ওপর আমার বাড়ি। ছোট্ট দোতলা একটা বিল্ডিং। একপাশে বাগানের মুখে গ্যারেজ। পেছনে একতলা সার্ভেন্ট কোয়ার্টার। এইসব মিলিয়ে কাঠা ছ’সাত জমি। বাকিটা বাগান। কত রকমের যে গাছপালা লাগিয়েছিল রেহনুমা, কত রকমের যে ঝোঁপঝাড় লাগিয়েছিল! দিনে দিনে বাগানটা ছেয়ে গেল। এখন দিনের বেলাও বাগানের কিছু কিছু ঝোপে রীতিমত অন্ধকার জমে থাকে। একজন মালি রাখতে হয়েছে, সারাদিন বাগানটার তদারকি করে সে। আগাছা পরিষ্কার করে। জলটল দেয়। সিজনাল গাছপালা এনে লাগায়। ফলে সব সময় কিছু না কিছু ফুল থাকেই বাগানটায়।
রেহনুমার ছিল গোলাপের শখ। বাগানের মাঝখানটায় আলাদা ঘের দেয়া একটা জায়গা করিয়েছিল সে। কাঠাখানেক জমি। তাতে শুধু গোলাপ। ইয়া বড় বড় একেকটা। একটা কালো গোলাপের চারা আনল একবার। প্রচুর টাকা খরচ করে। তারপর মাস তিনেক সেই চারাটি নিয়ে কী ব্যস্ততা তার! সারাদিন মেতে থাকত। রাতেরবেলা আমাদের দাম্পত্য আলাপের সময়ও গোলাপচারাটির কথা বলত। কখনও কখনও আমি খুব বিরক্ত হতাম।
সেই চারাটি এখন মস্ত ঝোঁপ হয়ে গেছে। কলম কেটে মালি তা থেকে দশবারটি নতুন কালো গোলাপের গাছ করেছে। এখন তাতে থরেবিথরে ফুটে থাকে গোলাপ। গাছগুলোর দিকে তাকালেই আমার রেহনুমার কথা মনে পড়ে। এতসব ফেলে রেহনুমা যে কেন চলে গেল!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি তারপর বারান্দা থেকে ফিরে আসি। বাথরুম ইত্যাদি সেরে খাবার টেবিলে গিয়ে বসি। ঝি-চাকররা নাশতা রেডি করে রাখে। চটপট খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। অফিস।