ভয় পাবে নাকি?
নীলু মাথা নেড়ে বলল, হু, পাবে। ছোট কাকু অবশ্য বলে, ভূত-টুত কিছু নেই। মানুষের বানানো সব। তবু আমি জানি আপনাকে দেখে সে ভয় পাবে।
ভূত এ কথা শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইল।
শেষে বলল, তোমার ছোট কাকু ভূত বিশ্বাস করে না?
জি না।
একটুও না?
উহুঁ।
আচ্ছা দেখাচ্ছি মজা।
নীলু ভয়ে পেয়ে বসল, না না, ছোট কাকু খুব ভালো। সত্যি বলছি।
ভূতটা হাসিমুখে বলল, বেশি ভয় দেখাব না নীলু। অল্প, খুব অল্প। দেখবে কেমন মজা হয়।
নীলু কী আর করে। খানিকক্ষণ ভেবেটেবে রাজি হয়ে গেল। ভূতটা হইয়ুকে বলল, হইয়ু মা, নীলুর খাটের নীচে বসে থাক। নীলুর কাকা যদি ভয় পেয়ে এ ঘরে আসেন তবে তোকে দেখে আরও ভয় পাবেন।
এই বলে ভূত পর্দা সরিয়ে চলে গেল পাশের ঘরে। আর হইয়ু বলল, নীলু, তোমার পুতুলটা নিয়ে যাই সঙ্গে?
আচ্ছা যাও।
নীলুর কথা শেষ হবার আগেই ও-ঘর থেকে একটা চেয়ার উল্টে পড়ার শব্দ হলো। তারপর শোনা গেল ছোট কাকু চেঁচিয়ে বললেন,
এটা কী আরে এটা কী!
ধড়মড় করে শব্দ হলো একটা। আর ছোট কাকু হাপাতে হাপাতে দৌড়ে এলেন নীলুর ঘরে। চেঁচিয়ে ডাকলেন, নীলু, ও নীলু।
কী হয়েছে কাকু?
ন, কিছু না। কিছু না।
ছোট কাকু রুমাল দিয়ে ঘন ঘন ঘাড় মুছতে লাগলেন। তারপর পানির জগটা দিয়ে ঢকঢক করে এক জগ পানি খেয়ে ফেললেন। নীলু খুব কষ্টে হাসি চেপে রেখে বলল, ভয় পেয়েছ কাকু?
ছোট কাকু থতমত খেয়ে বললেন, ভয়? হ্যা তা …। না না ভয় পাব কেন?
নীলু খিলখিল করে হেসে ফেলল। ছোট কাকু গম্ভীর হয়ে বললেন, হাসছ কেন নীলু?
নীলু হাসি থামিয়ে বলল, কাকু তুমি কখনো ভূত দেখেছ? কাকু দারুণ চমকে বললেন, ভূতের কথা এখন থাক নীলু।
এই বলেই তিনি ফস্ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন। আর তখনই টেলিফোন বেজে উঠল। কাকু বললেন,
হাসপাতাল থেকে টেলিফোন এসেছে রে নীলু। আমি যাই।
নীলু শুনল কাকু বলছেন, হ্যালো, কী বললেন? অবস্থা ভালো না? তারপর? ও আচ্ছা। এ-গ্রুপের রক্ত পাচ্ছেন না? হ্যালো হ্যালো!
এতক্ষণ নীলুর মার কথা মনেই পড়েনি নীলুর। এখন মনে পড়ে গেল। আর এমন কান্না পেল তার হইয়ুর বাবা ঘরে ঢুকে দেখে নীলু বালিশে মুখ গুঁজে খুব কাঁদছে। হইয়ুর বাবা খুব নরম সুরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা?
নীলু কথা বলল না আরো বেশি কাঁদতে লাগল।
কী হয়েছে লক্ষ্মী মা? হইয়ু তোমাকে খামছি দিয়েছে?
নীলু ফোফাতে ফোফাতে বলল, নো।
পেটব্যথা করছে?
উহুঁ। তবে কী হয়েছে মা?
বলো লক্ষ্মী মা।
নীলু ফোফাতে ফোফাতে বলল, মার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে।
কোথায় তোমার মা? হাসপাতালে।
নীলু তার মার অসুখের কথা বলল। ভূতটি নীলুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বারবার বলতে লাগল, আহা, বড় মুশকিল তো! কী করা যায়।
সে রুমাল দিয়ে নীলুর চোখ মুছিয়ে দিল।
ব্যাপার দেখে হইয়ু খুব ভয় পেয়ে গেল। সে আর খাটের নীচ থেকে বেরুলই না। একবার মাথা বের করে নীলুকে কাঁদতে দেখে সুড়ৎ করে মাথা নামিয়ে ফেলল নীচে। পুতুল নিয়ে খেলতে লাগল আপন মনে।
হইয়ুর বাবা কিছুতেই নীলুর কান্না থামাতে না পেরে বলল, এক কাজ করা যাক, আমি দেখে আসি তোমার মাকে, কেমন?
আপনাকে দেখে যদি মা ভয় পায়?
ভয় পাবে না। আমি বাতাস হয়ে থাকব কিনা! দেখতে পাবে না আমাকে। বলতে বলতেই সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। নীলু চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, হইয়ু, আমার একা একা একটুও ভালো লাগছে না। তুমি আসো।
হইয়ু হামাগুড়ি দিয়ে খাটের নীচ থেকে বেরুল। নীলু অবাক হয়ে দেখে তার সুন্দর পুতুলটা হইয়ুর হাতে। কিন্তু পুতুলটার মাথা নেই। শুধু শরীর আছে। নীলু ভীষণ অবাক হয়ে বলল, হইয়ু ভাই, আমার পুতুলের মাথাটা কোথায়?
হইয়ু কোনো কথা বলে না। এদিক-ওদিক চায়। নীলু বলল, বলো হইয়ু। ভেঙে ফেলেছ?
না।
তবে কী হয়েছে?
হইয়ু লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলল। কোনোমতে ফিসফিস করে বলল, খুব খিদে লেগেছিল, তাই খেয়ে ফেলেছি। তুমি রাগ করেছ নীলু?
নীলুর অবিশ্যি খুব রাগ লাগছিল। কিন্তু হইয়ুর মতো ভালো ভূতের মেয়ের উপর কতক্ষণ রাগ থাকে। তার উপর নীলু দেখল, হইয়ুর চোখ ছলছল করছে। তাই বলল, বেশি রাগ করিনি, একটু করেছি।
ওমা, এই কথাতেই হইয়ুর সে কী কান্না নীলু তার হাত ধরে তাকে এনে বসাল পাশে। তারপর বলল, কী কাণ্ড হইয়ু বোকা মেয়ের মতো কাঁদে।
এ কথাতেই হেসে উঠল হইয়ু।
খুব ভাব হয়ে গেল তাদের, সেকী হাসাহাসি দুজনের। আর হইয়ুর ডিগবাজি খাওয়ার ঘটা যদি তোমরা দেখতে নীলুকে খুশি করার জন্যে সে বাতাসের মধ্যে হেঁটে বেড়ালো খানিকক্ষণ। তারপর দুজন দুটি কোলবালিশ নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলল। কিন্তু নীলুর হলো মুশকিল। সে কোলবালিশ দিয়ে হইয়ুকে মারতে যায় আর সে বাতাস হয়ে মিলিয়ে যায়। নীলু রাগ করে বলল, উহুঁ, বাতাস হওয়া চলবে না।
নীলু তাকে দেখাল তার ছবির বই। ফুফু তাকে যে রঙপেন্সিল দিয়েছেন তা দিয়ে সে হইয়ুর চমৎকার একটি ছবি আঁকল। লাল কমল আর নীল কমলের গল্প বলল। তারপর বলল
ভাব ভাব ভাব
ভাব ভাব ভাব
নীল রঙের সিন্ধু
আমি তুমি বন্ধু
অর্থাৎ দুজন সারা জীবনের বন্ধু হয়ে গেল।
হইয়ুর বাবা যখন এলো তখন দুজনে হাত-ধরাধরি করে বসে আছে। হইয়ুর বাবা খুব খুশি হয়ে বলল, নীলু, আমার লক্ষ্মী মা কোথায়?