নীলু, ওমা নীলু।
কী বাবা?
নীলুর ইচ্ছে হলো চেঁচিয়ে বলে, চাই না উপহার। আমার কিছু লাগবে না। কিছু বলার আগেই ছোট কাকু নীলুকে কোলে করে নিয়ে এলেন দোতলায়।
তাকে সোফায় বসিয়ে নিয়ে এলেন সোনালি রঙের প্যাকেটটি।
দেখি লক্ষ্মী মেয়ে, প্যাকেটটা খোলো দেখি।
না।
আহা খোলো নীলু, দেখি কী আছে। নীলুর একটুও ভালো লাগছিল না। তবু সে খুলে ফেলল। আর অবাক হয়ে দেখল চমৎকার একটি পুতুল। ছোট কাকু চেটিয়ে উঠলেন, কী সুন্দর। কী সুন্দর।
ধবধবে সাদা মোমের মতো গা। লাল টুকটুকে ঠোঁট। কোঁকড়ানো ঘন কালো চুল। আর কী সুন্দর তার চোখ নীল রঙের একটি ফ্রক তার গায়ে, কী চমৎকার মানিয়েছে। নীলুর এত ভালো লাগল পুতুলটা। ছোট কাকু বললেন, কী নাম রাখবে পুতুলের?
নাম রাখতে হবে এ কথা নীলুর মনেই ছিল না। তাই তো, কী নাম রাখা যায়?
তুমি একটা নাম বলো কাকু।
এ্যানি রাখবে নাকি? মেম পুতুল তো, কাজেই বিলিতি নাম।
এটা মেম পুতুল কাকু?
হু। দেখছ না নীল চোখ। মেমদের চোখ থাকে নীল।
আরে তাই তো এতক্ষণ লক্ষই করেনি নীলু। পুতুলটির চোখ দুটি ঘন। নীল। সেই চোখে পুতুলটি আবার মিটমিট করে চায়।
ছোট কাকু, আমি এর নাম রাখব সোনামণি।
এ্যা ছিঃ সোনামণি তো বাজে নাম। তার চে বরং সুস্মিতা রাখা যায়।
উহুঁ, সোনামণি রাখব।
আচ্ছা বেশ বেশ। সোনামণিও মন্দ নয়।
নীলু সাবধানে সোনামণিকে বসাল টেবিলে। কী সুন্দর। কী সুন্দর। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়।
রাতের বেলা খেতে বসল তারা, তিনজন। নীলু ছোট কাকু আর সোনামণি। সোনামণি তো খাবে না, শুধু শুধু বসেছে।
ছোট কাকু খেতে খেতে মজার মজার গল্প করতে লাগলেন। বেকুব বামুনের গল্প শুনে নীলু হেসে বাঁচে না। ছোট কাকু যা হাসাতে পারেন। একসময় নীলু বলল, এবার একটা ভূতের গল্প বলো।
না, ভূতের গল্প শুনে তুমি ভয়ে কেঁদে ফেলবে।
ইস, আমি বুঝি ছোট মেয়ে বলে কাকু।
মামদো ভূতের গল্প বলব নাকি তবে?
মামদো ভূত কি মানুষ খায় কাকু?
খায় না আবার সুবিধামতো পেলেই কোৎ করে গিলে ফেলে।
ধড়াস করে উঠল নীলুর বুকটা। ছোট কাকু বললেন, তবে যে বলেছিলে ভয় পাবে না? এখন দেখি নীল হয়ে গেছ ভয়ে। কী সাহসী মেয়ে আমাদের নীলু।
একটুও ভয় পাইনি আমি, সত্যি বলছি।
নীলুর অবশ্য খুব ভয় লাগছিল। তবু সে এমন ভান করল, যেন একটুও ভয় পায়নি।
ছোট কাকু, দেখবে, আমি একা একা বারান্দায় যাব?
ছোট কাকু কিছু বলার আগেই ঝন ঝন করে টেলিফোন বেজে হাসপাতাল থেকে টেলিফোন করেছে। ছোট কাকু নীলুকে কি ছুঁই বললেন না। তবু নীলু বুঝল মায়ের অসুখ খুব বেড়েছে। সে ভয়ে ভয়ে বলল, গল্পটা বলবে না কাকু?
কোন গল্প?
ঐ যে, মামদো ভূতের গল্প? ছোট কাকু হাত নেড়ে বললেন, আরে পাগলি, ভূত বলে আবার কিছু আছে। নাকি! সব বাজে কথা।
বাজে কথা?
হ্যাঁ, খুব বাজে কথা। ভূত–প্রেত বলে কিছু নেই। সব মানুষের বানানো গল্প।
তুমি ভূত ভয় করো না কাকু?
আরে দূর। ভূত থাকলে তো ভয় করব!
এই বলেই ছোট কাকু আবার গম্ভীর হয়ে পড়লেন।
নীলুকে সবাই বলে ছোট মেয়ে ছোট মেয়ে। কিন্তু সে সব বুঝতে পারে। ছোট কাকুর হঠাৎ গম্ভীর হওয়া দেখেই সে বুঝতে পারছে মায়ের খুব বেশি অসুখ। নীলুর খুব খারাপ লাগতে লাগল। এত খারাপ যে, চোখে পানি এসে গেল। ছোট কাকু অবিশ্যি দেখতে পেলেন না–কারণ তার কাছে আবার টেলিফোন এসেছে। নীলু শুনতে পেল ছোট কাকু বললেন–
হ্যালো। হ্যাঁ হ্যাঁ।
এ তো দারুণ ভয়ের ব্যাপার।
হ্যাঁ, নীলু ভাত খেয়েছে।
দিচ্ছি, এক্ষুনি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
আচ্ছা আচ্ছা।
টেলিফোন নামিয়ে রেখেই ছোট কাকু বললেন, ঘুমুতে যাও নীলু।
নীলু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, মার কী হয়েছে কাকু?
কিছু হয়নি রে বেটি।
মা কখন আসবে?
কাল ভোরে এসে যাবে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো। ঘুম ভাঙতেই দেখবে মা এসে গেছেন।
নীলুর ঘরটি মার ঘরের মধ্যেই। শুধু পারটেক্সের দেয়াল দিয়ে করা। নীলু এখন বড় হয়েছে, তাই একা শোয়। তার একটুও ভয় করে না। তা ছাড়া সারা রাত মা কতবার এসে খোঁজ নিয়ে যান। নীলুর গায়ের কম্বল টেনে দেন। কপালে চুমু খান। কিন্তু আজ নীলু একা। ছোট কাকু বললেন, ভয় লাগবে না তো মা? মাথার কাছের জানালা বন্ধ করে দেব?
দাও।
মন? তোমার মার কোনো খবর আসে। যদি, সে জন্যে। আচ্ছা?
আচ্ছা।
তুমি পুতুল নিয়ে ঘুমুচ্ছ বুঝি নীলু?
হ্যাঁ কাকু।
ভয় পেলে আমাকে ডাকবে, কেমন?
ডাকব।
ছোট কাকু ঘরের পর্দা ফেলে চলে গেলেন। নীলুর কিন্তু ঘুম এলো না। সে জেগে জেগে ঘড়ির শব্দ শুনতে লাগল। টিক টিক টিক টিক। কিছুক্ষণ পর শুনল ছোট কাকু রেডিও চালু করে কী যেন শুনছেন। বক্তৃতাটতা হবে। তারপর আবার রেডিও বন্ধ হয়ে গেল। বারান্দার বাতি জ্বলল একবার। আবার নিভে গেল। রাত বাড়তে লাগল। নীলুর একফোঁটাও ঘুম এলো না। একসময় খুব পানির পিপাসা হলো তার। বিছানায় উঠে বসে ডাকল, ছোট কাকু, ছোট কাকু?
কেউ সাড়া দিল না। ছোট কাকুও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। নীলুর একটু ভয় ভয় করতে লাগল। আর ঠিক সেই সময় নীলুর মাথার জানালায় ঠক ঠক করে কে যেন শব্দ করল। আবার শব্দ হলো। সে সঙ্গে কে যেন ডাকল।
নীলু নীঈঈঈলুউউ।
নীলুর ভীষণ ভয় লাগলেও সে বলল, কে?
আমি। জানালা খোলো।
নীলু দারুণ অবাক হয়ে গেল। জানালার ওপাশে কে থাকবে? সেখানে তো দাঁড়াবার জায়গা নেই। নীলু বলল,