ও আচ্ছা। চেরাগের ভেতরেই তুমি থাকো?
জি।
করো কী?
ঘুমাই। তাহলে জনাব আমি এখন যাই।
বলতে বলতেই সে ধোয়া হয়ে চেরাগের ভেতর ঢুকে গেল। নিশানাথ বাবু স্তম্ভিত হয়ে দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। তারপর তার মনে হলো–এটা স্বপ্ন স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। বসে ঝিমাতে ঝিমাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের মধ্যে আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছেন।
তিনি হাত-মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লেন। পরদিন তাঁর আর এত ঘটনার কথা মনে রইল না। তাঁর খাটের নিচে পড়ে রইল আলাউদ্দিনের বিখ্যাত চেরাগ।
মাসখানেক পার হয়ে গেল। নিশানাথ বাবুর শরীর আরো খারাপ হলো। এখন তিনি আর হাঁটাহাঁটিও করতে পারেন না। বেশিরভাগ সময় বিছানায় শুয়ে-বসে থাকেন। এক রাতে ঘুমুতে যাবেন। মশারি খাটাতে গিয়ে দেখেন একদিকের পেরেক খুলে এসেছে। পেরেক বসানোর জন্য আলাউদ্দিনের চেরাগ দিয়ে এক বাড়ি দিতেই ঐ রাতের মতো হলো। তিনি শুনলেন গম্ভীর গলায় কে যেন বলছে–
জনাব, আপনার দাস উপস্থিত। হুকুম করুন।
তুমি কে?
সে কী! এর মধ্যে ভুলে গেলেন? আমি আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্য।
ও আচ্ছা, আচ্ছা। আরেক দিন তুমি এসেছিলে।
জি।
আমি ভাবছিলাম বোধহয় স্বপ্ন।
মোটেই স্বপ্ন না। আমার দিকে তাকান। তাকালেই বুঝবেন–এটা সত্য।
তাকালেও কিছু দেখি না রে বাবা। চোখ দুটা গেছে।
চিকিৎসা করাচ্ছেন না কেন?
টাকা কোথায় চিকিৎসা করাব?
কী মুশকিল! আমাকে বললেই তো আমি নিয়ে আসি। যদি বলেন তো এক্ষুনি এক কলসি সোনার মোহর এনে আপনার খাটের নিচে রেখে দেই।
আরে না, এত টাকা দিয়ে আমি করব কী? কদিনইবা আর বাঁচব।
তাহলে আমাকে কোনো একটা কাজ দিন। কাজ না করলে তো চেরাগের ভেতর যেতে পারি না।
বেশ, মশারিটা খাঁটিয়ে দাও।
.
দৈত্য খুব যত্ন করে মশারি খাটাল। মশারি দেখে সে খুব অবাক। পাঁচ হাজার বছর আগে নাকি এই জিনিস ছিল না। মশার হাত থেকে বাচার জন্যে মানুষ যে কায়দা বের করেছে তা দেখে সে মুগ্ধ।
জনাব, আর কিছু করতে হবে?
না, আর কী করবে! যাও এখন।
অন্য কিছু করার থাকলে বলুন, করে দিচ্ছি।
চা বানাতে পারো?
জি না। কীভাবে বানায়?
দুধ-চিনি মিশিয়ে।
না, আমি জানি না। আমাকে শিখিয়ে দিন।
থাক বাদ দাও, আমি শুয়ে পড়ব।
দৈত্য মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, আপনার মতো অদ্ভুত মানুষ জনাব আমি এর আগে দেখি নি।
কেন?
আলাউদ্দিনের চেরাগ হাতে পেলে সবার মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়। কী চাইবে, কী না চাইবে, বুঝে উঠতে পারে না, আর আপনি কিনা…
নিশানাথ বাবু বিছানায় শুয়ে পড়লেন। দৈত্য বলল, আমি কি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেব? তাতে ঘুমুতে আরাম হবে।
আচ্ছা দাও।
দৈত্য মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। নিশানাথ বাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙলে মনে হলো, আগের রাতে যা দেখেছেন সবই স্বপ্ন। আলাউদ্দিনের চেরাগ হচ্ছে রূপকথার গল্প। বাস্তবে কি তা হয়? হওয়া সম্ভব না।
দুঃখে-কষ্টে নিশানাথ বাবুর দিন কাটতে লাগল। শীতের শেষে তার কষ্ট চরমে উঠল। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না এমন অবস্থা। হোটেলের একটা ছেলে দুবেলা খাবার নিয়ে আসে। সেই খাবারও মুখে দিতে পারেন না। স্কুলের পুরান স্যাররা মাঝে মাঝে তাকে দেখতে এসে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেন–এ যাত্রা আর টিকবে না। বেচারা বড় কষ্ট করল। তাঁরা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে তিনশ টাকা নিশানাথ বাবুকে দিয়ে এলেন। তিনি বড় লজ্জায় পড়লেন। কারো কাছ থেকে টাকা নিতে তার বড় লজ্জা লাগে।
এক রাতে তাঁর জ্বর খুব বাড়ল। সেই সঙ্গে পানির পিপাসায় ছটফট করতে লাগলেন। বাতের ব্যথায় এমন হয়েছে যে, বিছানা ছেড়ে নামতে পারছেন না। তিনি করুণ গলায় একটু পরপর বলতে লাগলেন–পানি। পানি। গম্ভীর গলায় কে একজন বলল, নিন জনাব পানি।
তুমি কে?
আমি আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্য।
ও আচ্ছা, তুমি।
নিন, আপনি খান। আমি আপনাতেই চলে এলাম। যা অবস্থা দেখছি, না এসে পারলাম না।
শরীরটা বড়ই খারাপ করেছে রে বাবা।
আপনি ডাক্তারের কাছে যাবেন না, টাকা-পয়সা নেবেন না, আমি কী করব, বলুন?
তা তো ঠিকই, তুমি আর কী করবে!
আপনার অবস্থা দেখে মনটাই খারাপ হয়েছে। নিজ থেকেই আমি আপনার জন্যে একটা জিনিস এনেছি। এটা আপনাকে নিতে হবে। না নিলে খুব রাগ করব।
কী জিনিস?
একটা পরশপাথর নিয়ে এসেছি।
সে কি! পরশপাথর কি সত্যি সত্যি আছে নাকি?
থাকবে না কেন? এই তো, দেখুন। হাতে নিয়ে দেখুন।
নিশানাথ বাবু পাথরটা হাতে নিলেন। পায়রার ডিমের মতো ছোট। কুচকুচে কালো একটা পাথর। অসম্ভব মসৃণ।
এইটাই বুঝি পরশপাথর?
জি। এই পাথর ধাতুর তৈরি যে কোনো জিনিসের গায়ে লাগালে সেই জিনিস সোনা হয়ে যাবে। দাঁড়ান, আপনাকে দেখাচ্ছি।
দৈত্য খুঁজে খুঁজে বিশাল এক বালতি নিয়ে এলো। পরশপাথর সেই বালতির গায়ে লাগাতেই কাফেরঙের আভায় বালতি ঝকমক করতে লাগল।
দেখলেন?
হ্যাঁ দেখলাম। সত্যি সত্যি সোনা হয়েছে?
হ্যাঁ, সত্যি সেনা।
এখন এই বালতি দিয়ে আমি কী করব?
আপনি অদ্ভুত লোক, এই বালতির কত দাম এখন জানেন? এর মধ্যে আছে কুড়ি সের সোনা। ইচ্ছা করলেই পরশপাথর ছুঁইয়ে আপনি লক্ষ লক্ষ টন সোনা বানাতে পারেন।
নিশানাথ বাবু কিছু বললেন না, চুপ করে রইলেন। দৈত্য বলল, আলাউদ্দিনের চেরাগ যেই হাতে পায় সেই বলে পরশপাথর এনে দেবার জন্যে। কাউকে দেই না।