তিনি কোনো উত্তর দিলেন না, তবে মনে-মনে বললেন, ন ছাড়াও তো আরো সুন্দর সুন্দর বর্ণ আছে। গ ও তো সুন্দর বর্ণ। গ দিয়ে গু রেখে ফেললে আরো ভালো হতো। মানুষের নাম হিসেবে খুব আনকমন হতো। এর আগে এই নাম কেউ রাখেনি। তবে মুখে কিছু বললেন না। এমনিতেই জামাইরা তাঁকে পছন্দ করে না। কী দরকার।
শীশী তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। এখনো তার পা দুলছে। মনে হয় স্থির হয়ে বসতে পারে না। এখনই একে একটা কড়া ধমক দেবেন কিনা মোবারক হোসেন সাহেব বুঝতে পারছেন না। ধমক খেয়ে কেঁদে ফেলবে কিনা কে জানে। কাঁদলে সমস্যা হবে।
ছেলেটা বলল, আপনি আমার সঙ্গে খেলবেন?
মোবারক হোসেন ছেলের স্মার্ট ভঙ্গি দেখে মুগ্ধ হলেন।
আমার সঙ্গে খেলতে চাও?
হুঁ।
কী খেলা?
আপনি যে খেলা জানেন সেই খেলাই খেলব। আপনি কোন কোন খেলা জানেন।
আমি অনেক খেলাই জানি, যেমন ধর হেলিকপ্টার খেলা…
মজার খেলা?
মনে হয় বেশ মজার। আমি সিলিং ফ্যান ধরে ঝুলে পড়ব, আর তুমি ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দেবে।
ছেলেটা মহাউৎসাহের সঙ্গে বলল, আসুন খেলি।
এখানে সিলিং ফ্যান নেই, এই খেলা খেলা যাবে না।
ছেলেটা হতাশ গলায় বলল, আর কী খেলা জানেন?
প্যারাসুট খেলা বলে একটা খেলা আছে। আমার দুই নাতি একবার খেলেছে। এটাও মন্দ না। এই খেলাতে একটা ভোলা ছাতার হাতল ধরে গ্যারাজের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামতে হয়।
খুব মজার খেলা?
মোটামুটি মজার তবে সামান্য সমস্যা আছে। হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে কিছুদিন থাকতে হয়। বড় নাতিটা প্রায় এক মাসের মতো ছিল।
ছেলেটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। মোবারক হোসেন সাহেবের একটু মায়া হলো। বাচ্চা মানুষ খেলতে চাচ্ছে, খেলার বন্ধু পাচ্ছে না।
শোন খোকা! বিকেলে আসবে, তখন বাচ্চাকাচ্চারা থাকবে, ওদের সঙ্গে খেলবে। দুপুরবেলা খেলার সময় না।
দুপুরবেলা কীসের সময়?
দুপুর হচ্ছে হোম ওয়ার্ক করার সময়, কিংবা মার পাশে শুয়ে ঘুমুবার সময়।
ছেলেটা গম্ভীর হয়ে অবিকল বড়দের মতো বলল, ও আচ্ছা, আমি জানতাম না। আমি তো মানুষের ছেলে না, আমি হচ্ছি পরীদের ছেলে। এইজন্যে মানুষের নিয়মকানুন জানি না।
তুমি পরীদের ছেলে?
জি।
মোবারক হোসেন এই ছেলের বানিয়ে কথা বলার ক্ষমতায় চমৎকৃত হলেন। এ ছেলে বড় হলে নির্ঘাৎ কোনো রাজনৈতিক দলের লিডার হবে। দিব্যি বলে যাচ্ছে— আমি মানুষের ছেলে না, আমি হচ্ছি পরীদের ছেলে। ফাজিলের ফাজিল।
তুমি যখন পরীদের ছেলে তখন নিশ্চয়ই উড়তে পার।
জি পারি।
পাখা তো দেখছি না। পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে এসেছ বোধহয়।
মার কাছে রেখে এসেছি।
মার কাছে রেখে আসাই ভালো। তুমি বাচ্চা মানুষ, হারিয়ে ফেলতে পার। কিংবা ময়লা করে ফেলতে পার। তুমি থাক কোথায়? পরীর দেশে?
ছেলে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। বানিয়ে বানিয়ে কথা যে বলে যাচ্ছে তার জন্যে তার মধ্যে কোনো রকম বিকার দেখা যাচ্ছে না। মোবারক হোসেনের ইচ্ছা করছে মিথ্যা কথা বলার জন্যে ঠাস করে এর গালে একটা চড় বসিয়ে দিতে।
তোমার পায়ের জুতা তো মনে হচ্ছে বাটা কোম্পানির। পরীর দেশেও তাহলে বাটা কোম্পানি দোকান খুলেছে?
জুতা আমার মা এখান থেকে কিনে দিয়েছে। পরীর দেশের ছেলেমেয়েরা জুতা পরে না। তারা তো আকাশে আকাশেই ওড়ে, তাদের জুতা পরতে হয় না।
মোবারক হোসেন সাহেব ছেলের বুদ্ধি দেখে অবাক হলেন। সুন্দর করে নিজেকে কাটান দিয়ে যাচ্ছে। এই ছেলে রাজনৈতিক দলের নেতা হবে না, নেতাদের এত বুদ্ধি থাকে না।
তুমি তাহলে পরীদের ছেলে, এখানে বেড়াতে এসেছ?
মানুষের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে এসেছি। ওরা কত সুন্দর সুন্দর খেলা জানে।
তুমি তাহলে প্রথম পরীর বাচ্চা যে মানুষের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে এসেছে।
না তো, আমরা সব সময় আসি।
সব সময় আস?
জি। ওদের সঙ্গে খেলি তারপর চলে যাই। ওরা বুঝতে পারে না।
তাই নাকি?
জি। যখনই দেখবেন একদল ছেলেমেয়ে খেলছে তখনই জানবেন ওদের মধ্যে অতি অবশ্যই দু-একজন পরীর ছেলেমেয়ে আছে।
পাখা ছাড়া আস কী করে?
আমাদের উড়তে পাখা লাগে না। পাখাটা হচ্ছে আমাদের এক ধরনের পোশাক। জন্মদিনে আমরা নতুন পাখা পাই। আবার দুষ্টুমি করলে মারা আমাদের পাখা নিয়ে নেন। আমার কটা পাখা আছে জানেন? সব মিলিয়ে সাতটা—সেভেন।
তুমি ইংরেজিও জানো? পরীর দেশে ইংরেজি চালু আছে?
আপনি আমার সঙ্গে এমন রেগে রেগে কথা বলছেন কেন?
মোবারক হোসেন সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, দেখ খোকা–কী যেন নাম তোমার?
শীশী।
দেখ শীশী। তোমার কথা শুনে রাগে আমার শরীর রি রি করছে। এই বয়সে তুমি যে মিথ্যা শিখেছ…
আপনার ধারণা আমি মিথ্যা কথা বলছি?
অবশ্যই মিথ্যা কথা বলছ। এই মিথ্যা বলার জন্যে তোমাকে কানে ধরে উঠবস করানো দরকার।
বাহ আপনাদের মিথ্যা বলার শাস্তিটা তো খুব মজার?
কানে ধরে উঠবস তোমার কাছে মজা মনে হলো?
অবশ্যই মজার। আমরা মিথ্যা বললে কী শাস্তি হয় জানেন? আমরা মিথ্যা বললে আমাদের পাখায় কালো দাগ দিয়ে দেয়া হয়। যে যত মিথ্যা বলে তার পাখায় ততই কালো দাগ পড়ে।
মোবারক হোসেন এই ছেলের গুছিয়ে কথা বলার ক্ষমতায় আরো মুগ্ধ হলেন। ছেলেটা পড়াশোনায় কেমন কে জানে। ভালো হওয়া তো উচিত।
শোন খোকা— তোমার রোল নাম্বার কত? রোল নাম্বার মানে কী?
ক্লাসে যে পড় তোমার রোল কত?